পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVSV2 রবীন্দ্র-রচনাবলী ব্যক্তিই সুন্দর সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ রস পায় না। অনেকের মন রূপকানা, তাদের ব্যক্তিগত অভিরুচির সঙ্গে বিশ্বরুচির মিল নেই । মানুষের মধ্যে অনেকে আছে স্বভাবতই বিজ্ঞানমূঢ়, বিশ্ব সম্বন্ধে তাদের ধারণা মোহাচ্ছন্ন বলেই তা বহু, এক সংস্কারের সঙ্গে আর-এক সংস্কারের মিল হয় না। অথচ নিজ নিজ অন্ধ সংস্কারের সত্যতা সম্বন্ধে তাদের প্রত্যেকের এমন প্ৰচণ্ড দম্ভ যে তা নিয়ে তারা খুনো খুনি করতেও প্ৰস্তুত । তেমনি সংসারে স্বভাবতই অরসিক বা বেরসিকের অভাব নেই ; তাদেরও মতভেদ সাংঘাতিক হয়ে ওঠে । নিম্নসপ্তক থেকে উচ্চসপ্তক পর্যন্ত উদারা মুদারা তারা নানা পর্যায়ের জন্মমৃঢ়তা আছে বলেই যেমন জ্ঞানের বিশ্বভূমীন সম্পূর্ণতায় অশ্রদ্ধা করা যায় না, সৌন্দর্যের আদর্শ সম্বন্ধেও তেমনি । বারট্রান্ড রাসেল কোনো-এক গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন যে, বেটােভনের ‘সিম্ফনিকে বিশ্বমনের রচনা বলা যায় না, সেটা ব্যক্তিগত ; অর্থাৎ, সেটা তো গাণিতিক তত্ত্বের মতো নয় যার উদ্ভাবনা সম্বন্ধে ব্যক্তিগত মন উপলক্ষমাত্র, যা নিখিল মনের সামগ্ৰী । কিন্তু, যদি এ কথা স্বীকার করতে হয় যে, বেটোেভনের রচনা সকলেরই ভালো লাগা উচিত অর্থাৎ ঠিকমত শিক্ষা পেলে, স্বাভাবিক চিত্তজড়তা না থাকলে, অজ্ঞান অনভ্যাসের আবরণ দূর হলে, সকল মানুষের তা ভালো লাগবে, তা হলে বলতেই হবে শ্রেষ্ঠগীত-রচয়িতার শ্রেষ্ঠত্ব সকল মানুষের মনেই সম্পূৰ্ণ আছে, শ্রোতৃরূপে ব্যক্তিবিশেষের মনে उों वांक्षोंsरठ । 她 বুদ্ধি জিনিসটা অস্তিত্বরক্ষার পক্ষে অপরিহার্য, কিন্তু সৌন্দর্যবোধের অপূর্ণতা সত্ত্বেও সংসারে সিদ্ধিলাভের দৃষ্টান্ত অনেক আছে । সৌন্দর্যবোধের কোনো সাংঘাতিক তাগিদ নেই। এ সম্বন্ধে যথেচ্ছাচারের কোনাে দণ্ডনীয় বাধা নেই। যুক্তিস্বীকারকারী বুদ্ধি মানুষের মনে যত সুনিশ্চিত হয়েছে প্ৰাণের বিভাগে, শাসনের অভাবে সৌন্দর্যস্বীকারকারী রুচি তেমন পাকা হয় নি । তবু সমস্ত মানবসমাজে সৌন্দর্যসৃষ্টির কাজে মানুষের যত প্ৰভূত শক্তির প্রয়োগ হচ্ছে এমন অল্প বিষয়েই । অথচ, জীবনধারণে এর প্রয়োজন নেই, এর প্রয়োজন আত্মিক । অর্থাৎ, এর দ্বারা বাইরের জিনিসকে পাই নে, অন্তরের দিক থেকে দীপ্তিমান হই পরিত গু হই । এই পৱিত গুপ্ত হওয়ার দ্বারা যাকে জানি তাকে বলি, রাসো বৈ সৰ্ম্ম । এই হওয়ার দ্বারা পাওয়ার কথা উপনিষদে বার বার শোনা যায় ; তার থেকে এই বুঝি, মানুষের যা চরম পাবার বিষয় তার সঙ্গে মানুষ একাত্মক, মানুষ তারই মধ্যে সত্য— কেবল তার বোধের বাধা আছে | নাশাস্তমানসো বাপি প্রজ্ঞানেনৈনমাপুয়াৎ । বলছেন, কেবল জানার দ্বারা তাকে পাওয়া যায় না । হওয়ার দ্বারা পেতে হবে, দুশ্চরিত থেকে বিরত হওয়া, সমাহিত হওয়া, রিপূদমন করে আচঞ্চলমন হওয়া দ্বারাই তাকে পেতে হবে । অর্থাৎ, এ এমন পাওয়া যা আপনারই চিরন্তন সত্যকে পাওয়া । পর্বে বলেছি, ভৌতিক সত্যকে বিশুদ্ধ করে দেখতে গেলে কাছের সমস্ত মলিনতা ও চাঞ্চল্য, ব্যক্তিগত সমস্ত বিকার দূর করা চাই । আত্মিক সত্য সম্বন্ধে সে কথা আরো বেশি খাটে । যখন পশুসত্তার বিকার আমরা আত্মিক সত্যে আরোপ করি তখন সেই প্ৰমাদ সব চেয়ে সাংঘাতিক হয়ে ওঠে । কেননা, তখন আমাদের হওয়ার ভিত্তিতেই লাগে আঘাত । জানার ভুলের চেয়ে হওয়ার ভুল কত সর্বনেশে তা বুঝতে পারি যখন দেখতে পাই বিজ্ঞানের সাহায্যে যে শক্তিকে আমরা আয়ত্ত করেছি সেই শক্তিই মানুষের হিংসা ও লোভের বাহন হয়ে তার আত্মঘাতকে বিস্তার করছে পৃথিবীর এক প্ৰান্ত থেকে অন্য প্রান্তে । এইজন্যেই সম্প্রদায়ের নামে ব্যক্তিগত বা বিশেষজনগত স্বভাবের বিকৃতি মানুষের পাপবুদ্ধিকে যত প্রশ্রয় দেয় এমন বৈজ্ঞানিক ভ্ৰান্তিতে কিংবা বৈষয়িক বিরোধেও না । সাম্প্রদায়িক দেবতা তখন বিদ্বেষবুদ্ধির, অহংকারের, অবজ্ঞাপরতার, মৃঢ়তার দৃঢ় আশ্রয় হয়ে দাড়ায় ; শ্রেয়ের নামাঙ্কিত পতাকা নিয়ে অশ্রেয় জগদব্যাপী ; অশান্তির প্রবর্তন করে- স্বয়ং দেবত্ব অবমানিত হয়ে