পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৬৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Se8 O রবীন্দ্র-রচনাবলী করে বলতে পারে, ধর্মযুদ্ধে মৃতো ‘বাপি তেন লোকত্ৰয়ং জি তম । মৃত্যুতে সেই পৌরুষকে সে প্রমাণ করে যা তার দেবত্বের লক্ষণ, যা মৃত্যুর অতীত । শ্ৰেয় প্ৰেয় নিয়ে এতক্ষণ যা বলা হল সেটা সমাজস্থিতির দিক দিয়ে নয় । নিন্দা-প্ৰশংসার ভিত্তিতে পাকা করে গেথে, শাসনের দ্বারা, উপদেশের দ্বারা, আত্মরক্ষার উদ্দেশে সমাজ যে ব্যবস্থা করে থাকে তাতে চিরন্তন শ্রেয়োধর্ম গৌণ, প্ৰথাঘটিত সমাজরক্ষাই মুখ্য । তাই এমন কথা শোনা যায়, শ্ৰেয়োধর্মকে বিশুদ্ধভাবে সমাজে প্রবর্তন করা ক্ষতিকর । প্রায়ই বলা হয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে ভূরিপরিমাণ মৃঢ়তা আছে, এইজন্যে অনিষ্ট থেকে ঠেকিয়ে রাখতে হলে মোহের দ্বারাও তাদের মন ভোলানো চাই, মিথ্যা উপায়েও তাদের ভয় দেখানো বা সান্তনা দেওয়া দরকার, তাদের সঙ্গে এমন ভাবে ব্যবহার করা দরকার যেন তারা চিরশিশু বা চিরপশু । ধর্মসম্প্রদায়েও যেমন সমাজেও তেমনি, কোনো এক পর্বতনকালে যে-সমস্ত মত ও প্ৰথা প্ৰচলিত ছিল সেগুলি পরবর্তীকালেও আপনি অধিকার ছাড়তে চায়, না ; পতঙ্গমহলে দেখা যায়, কোনো কোনো নিরীহ পতঙ্গ ভীষণ পতঙ্গের ছদ্মবেশে নিজেকে বাচায় । সমাজরীতিও তেমনি । তা নিত্যধর্মের ছদ্মবেশে আপনাকে প্ৰবল ও স্থায়ী করতে চেষ্টা করে । এক দিকে তার পবিত্রতার বাহ্যিাড়ম্বর, অন্য দিকে পারিত্রিক দুৰ্গতির বিভীষিকা, সেইসঙ্গে সম্মিলিত শাসনের নানাবিধ কঠোর, এমন-কি, অন্যায় প্ৰণালী- ঘর-গড়া নরকের তৰ্জনীসংকেতে নিরর্থক অন্ধ আচারের প্রবর্তন । রাষ্টতন্ত্রে এই বুদ্ধিরই প্ৰতীক আণ্ডামান, ফ্রান্সের ডেভিল আইল্যােনড, ইটালির লিপ্যারি দ্বীপ । এদের ভিতরের কথা এই যে, বিশুদ্ধ শ্রেয়োনীতি ও লোকস্থিতি এক তালে চলতে পারে না । এই বুদ্ধির সঙ্গে চিরদিনই তাদের লড়াই চলে এসেছে র্যারা সীতাকে শ্রেয়কে মনুষ্যত্বকে চরম লক্ষ্য বলে শ্রদ্ধা করেন । রাজ্যের বা সমাজের উপযোগিতারূপে শ্ৰেয়ের মূল্যবিচার এ প্রবন্ধের উদ্দেশ্য নয় । শ্রেয়কে মানুষ যে স্বীকার করেছে, সেই স্বীকৃতির আশ্রয় কোথায়, সত্য কোথায়, সেইটেই আমার আলোচ্য । রাজ্যে সমাজে নানাপ্রকার স্বার্থসাধনের ক্ষেত্রে প্রতিদিনের ব্যবহারে তার প্রতিবাদ পদে পদে, তবুও আত্মপরিচয়ে মানুষ তাকে শ্ৰেষ্ঠ স্থান দিয়েছে, তাকেই বলেছে ধর্ম অর্থাৎ নিজের চরম স্বভাব ; শ্ৰেয়ের আদর্শ সম্বন্ধে দেশকলপাত্রভেদে যথেষ্ট মতভেদ সত্ত্বেও সেই শ্ৰেয়ের সত্যকে সকল মানুষই শ্ৰদ্ধা করেছে, এইটোতে মানুষের ধর্মের কোন স্বরূপ প্ৰমাণিত হয়। সেইটো আমি বিচার করেছি । ‘হয়’ এবং “হওয়া উচিত’। এই দ্বন্দ্ব মানব-ইতিহাসের আরম্ভকাল থেকেই প্রবলবেগে চলছে, তার কারণ বিচার করতে গিয়ে বলেছি- মানুষের অন্তরে এক দিকে পরম মানব, আর-এক দিকে স্বার্থসীমাবদ্ধ জীবমানব, এই উভয়ের সামঞ্জস্যচেষ্টাই মানব-মনের নানা অবস্থা-অনুসারে নানা আকারে প্রকারে ধৰ্মতন্ত্ররূপে অভিব্যক্ত । নইলে কেবল সুবিধা-অসুবিধা প্ৰিয়-অপ্রিয় প্ৰবল থাকত জৈবিক ক্ষেত্রে জীবধর্মে ; পাপ-পুণ্য কল্যাণ-অকল্যাণের কোনো অর্থই থাকত না । মানুষের এই—যে কল্যাণের মতি এর সত্য কোথায় । ক্ষুধাতৃষ্ণার মতো প্ৰথম থেকেই আমাদের মনে তার বোধ যদি পূর্ণ থাকত তা হলে তার সাধনা করতে হত না । বলব, বিশ্বমানবমনে আছে। কিন্তু, সকল মানুষের মন সমষ্টিভূত হয়ে বিশ্বমানবমনের মহাদেশ সৃষ্টি, এ কথা বলব না । ব্যক্তিমন বিশ্বমনে আশ্রিত কিন্তু ব্যক্তিমনের যোগফল বিশ্বমন নয় । তাই যদি হত তা হলে যা আছে তাই হত একান্ত, যা হতে পারে তার জায়গা পাওয়া যেত না । অথচ, যা হয় নি, যা হতে পারে, মানুষের ইতিহাসে তারই জোর তারই দাবি বেশি । তারই আকাঙ্ক্ষা দুনিবার হয়ে মানুষের সভ্যতাকে যুগে যুগে বর্তমানের সীমা পার করিয়ে দিচ্ছে । সেই আকাঙ্ক্ষা শিথিল হলেই সত্যের অভাবে সমাজ শ্ৰীহীন 3 | দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, আমার ব্যক্তিগত মনে সুখদুঃখের যে অনুভূতি সেটা বিশ্বমনের মধ্যেও সত্য কি না । ভেবে দেখলে দেখা যায়, অহংসীমার মধ্যে যে সুখদুঃখ আত্মার সীমায় তার রূপান্তর ঘটে । যে মানুষ সত্যের জন্যে জীবন উৎসর্গ করেছে, দেশের জন্যে, লোকহিতের জন্যে- বৃহৎ ভূমিকায় যে নিজেকে দেখছে, ব্যক্তিগত সুখদুঃখের অর্থ তার কাছে উলটাে হয়ে গেছে। সে মানুষ সহজেই সুখকে