পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

No8tr রবীন্দ্র-রচনাবলী বিশ্বে- শোনো বিশ্বজন, তার আহবান শোনো, যে আহবানে ভয় যায় ছুটে, স্বাৰ্থ হয় লজ্জিত, মৃত্যুঞ্জয় শৃঙ্গ ধ্বনি করে ওঠেন মৃত্যুদুঃখবন্ধুর অমৃতের পথে । ভূমা থেকে উৎশিষ্ট যে শ্রেষ্ঠতার কথা অথর্ববেদ বলেছেন সে কোনো একটিমাত্র বিশেষ সিদ্ধিতে নয় । মানুষের সকল তপস্যাই তার মধ্যে, মানুষের বীর্যং লক্ষ্মীর্বলং সমস্ত তার অন্তর্গত । মনুষ্যত্বের বহুধা বৈচিত্ৰ্যকে একটিমাত্র বিন্দুতে সংহত করে নিশ্চল করলে হয়তো তার আত্মভোলা একটা আনন্দ আছে । কিন্তু, ততঃ কিম । কী হবে সে আনন্দে । সে আনন্দকে বলব না শ্রেয়, বলব না। চরম সত্য । সমস্ত মানবসংসারে যতক্ষণ দুঃখ আছে, অভাব আছে, অপমান আছে, ততক্ষণ কোনো একটিমাত্র মানুষ নিষ্কৃতি পেতে পারে না । একটিমাত্ৰ প্ৰদীপ অন্ধকারে একটুমাত্র ছিদ্র করলে তাতে রাত্রির ক্ষয় হয় না, সমস্ত অন্ধকারের অপসারণে রাত্রির অবসান । সেইজন্যে মানুষের মুক্তি যে মহাপুরুষেরা কামনা করেছেন তাদেরই বাণী “সম্ভবামি যুগে যুগে” । যুগে যুগেই তো জন্মাচ্ছেন তারা দেশে দেশে । আজও এই মূহুর্তেই জন্মেছেন, কালও জন্মাবেন । সেই জন্মের ধারা চলেছে ইতিহাসের মধ্য দিয়ে, এই < r <&r (EGS- GT22N i I and my Father are one. সোহহম মন্ত্র মুখে আউড়িয়ে তুমি দুরাশা কর কর্ম থেকে ছুটি নিতে ! সমস্ত পৃথিবী রইল পড়ে, তুমি একা যাবে দায় এড়িয়ে ! যে ভীরু চোখ বুজে মনে করে “পালিয়েছি”। সে কি সত্যই পালিয়েছে। সোহহম সমস্ত মানুষের সম্মিলিত অভিব্যক্তির মন্ত্র, কেবল একজনের না । ব্যক্তিগত শক্তিতে নিজে কেউ যতটুকু মুক্ত হচ্ছে সেই মুক্তি তার নিরর্থক যতক্ষণ সে তা সকলকে না দিতে পারে । বুদ্ধদেব আপনার মুক্তিতেই সত্যই যদি মুক্ত হতেন, তা হলে একজন মানুষের জন্যেও তিনি কিছুই করতেন না । দীর্ঘজীবন ধরে তার তো কর্মের অন্ত ছিল না । দৈহিক প্ৰাণ নিয়ে তিনি যদি আজ পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন তা হলে আজ পর্যন্তই তাকে কাজ করতে হত আমাদের সকলের চেয়ে বেশি । কেননা, র্যারা মহাত্মা তারা বিশ্বকমা । নীহারিকার মহাক্ষেত্রে যেখানে জ্যোতিষ্ক সৃষ্টি হচ্ছে সেখানে মাঝে মাঝে এক-একটি তারা দেখা যায় ; তারা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় সমস্ত নীহারিকার বিরাট অন্তরে সৃষ্টি-হােমহুতাশনের উদ্দীপনা । তেমনি মানুষের ইতিহাসের ক্ষেত্রে মাঝে মাঝে মহাপুরুষদের দেখি । তাদের থেকে এই কথাই বুঝি যে, সমস্ত মানুষের অস্তরেই কাজ করছে অভিব্যক্তির প্রেরণা । সে ভূমার অভিব্যক্তি । জীবমানব কেবলই তার অহং-আবরণ মোচন করে আপনাকে উপলব্ধি করতে চাচ্ছে বিশ্বমানবে । বস্তুত, সমস্ত পৃথিবীরই অভিব্যক্তি আপনি সত্যকে খুঁজছে সেইখানে, এই বিশ্বপূথিবীর চরম সত্য সেই মহামানবে। পৃথিবীর আরম্ভকালের লক্ষ লক্ষ যুগের পরে মানুষের সূচনা । সেই সাংখ্যিক তথ্য মনে নিয়ে কালের ও আয়তনের পরিমাণে মানুষের ক্ষুদ্রতা বিচার করে কোনো কোনো পণ্ডিত অভিভূত হয়ে পড়েন । পরিমাণকে অপরিমেয় সত্যের চেয়ে বড়ো করা একটা মোহ মাত্র । যাকে আমরা জড় বলি সেই অব্যক্ত প্ৰাণ বহু কোটি কোটি বৎসর সুপ্ত ছিল। কিন্তু, একটিমাত্র প্রাণকণা যেদিন এই পৃথিবীতে দেখা দিল সেইদিনই জগতের অভিব্যক্তি তার এটি মহৎ’ অর্থে এসে পৌছল । জড়ের বাহ্যিক সত্তার মধ্যে দেখা দিল একটি আন্তরিক সত্য। প্ৰাণ আন্তরিক । যেহেতু সেই প্ৰাণকণা জড়পুঞ্জের তুলনায় দৃশ্যত অতি ক্ষুদ্র এবং যেহেতু সুদীর্ঘকালের এক প্রান্তে তার সদ্য জন্ম, তাই তাকে হেয় করবে। কে । মুকতার মধ্যে এই-যে অর্থ অবারিত হল তার থেকে মানুষ বিরাট প্ৰাণের রূপ দেখলে ; বললে, যদিদং কিঞ্চি সৰ্বং প্রাণ এজাতি নিঃসৃতম। যা-কিছু সমস্তই প্ৰাণ থেকে নিঃসৃত হয়ে প্ৰাণে কম্পিত হচ্ছে। আমরা জড়কে তথ্যরূপে জানি, কেননা সে যে বাইরের । কিন্তু, প্ৰাণকে আমাদের অন্তর থেকে জানি সত্যরূপে । প্ৰাণের ক্রিয়া অন্তরে অন্তরে- তার সমস্তটাই গতি । তাই চলার একটিমাত্র ভাষা আমাদের কাছে অব্যবহিত, সে আমাদের প্রাণের ভাষা । চলা ব্যাপারকে অন্তর থেকে সত্য করে চিনেছি নিজেরই মধ্যে । বিশ্বে অবিশ্রাম চলার যে উদ্যম তাকে উত্তাপই বলি, বিদ্যুৎই বলি, সে কেবল একটা কথা মাত্র । যদি বলি, এই চলার মধ্যে আছে প্ৰাণ, তা হলে এমন-কিছু বলা হয় আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে যার অর্থ আছে। সেই সঙ্গে এও বুঝি, আমার প্রাণ যে চলছে সেও ঐ বিশ্বপ্ৰাণের