পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৭৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী 8ع ?) তিনিই আমাদের মনে চৈতন্য প্রেরণ করছেন । চৈতন্য ও বিশ্ব, বাহিরে ও অন্তরে সৃষ্টির এই দুই ধারা এক ধারায় মিলছে । এমনি করে ধ্যানের দ্বারা র্যাকে উপলব্ধি করছি তিনি বিশ্বাত্মাতে আমার আত্মাতে চৈতন্যের যোগে যুক্ত । এইরকম চিন্তার আনন্দে আমার মনের মধ্যে একটা জ্যোতি এনে দিলে । এ আমার সুস্পষ্ট মনে আছে | 锅 যখন বয়স হয়েছে, হয়তো আঠারো কি উনিশ হবে, বা বিশও হতে পারে, তখন চৌরঙ্গিতে ছিলুম। দাদার সঙ্গে । এমন দাদা কেউ কখনো পায় নি । তিনি ছিলেন একাধারে বন্ধু, ভাই, সহযোগী । তখন প্ৰত্যুষে ওঠা প্ৰথা ছিল । আমার পিতাও খুব প্ৰত্যুষে উঠতেন । মনে আছে, একবার। ডালহৌসি পাহাড়ে পিতার সঙ্গে ছিলুম । সেখানে প্ৰচণ্ড শীত । সেই শীতে ভোরে আলো-হাতে এসে আমাকে শয্যা থেকে উঠিয়ে দিতেন । সেই ভোরে উঠে একদিন চৌরঙ্গির বাসার বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলম । তখন ওখানে ফ্রি ইস্কুল বলে একটা ইস্কুল ছিল । রাস্তাটা পেরিয়েই ইস্কুলের হাতাটা দেখা যেত । সে দিকে চেয়ে দেখলুম, গাছের আড়ালে সূর্য উঠছে। যেমনি সূর্যের আবির্ভাব হল গাছের অন্তরালের থেকে, আমনি মনের পর্দা খুলে গেল । মনে হল, মানুষ আজন্ম একটা আবরণ নিয়ে থাকে । সেটাতেই তার স্বাতন্ত্র্য । স্বাতন্ত্র্যের বেড়া লুপ্ত হলে সাংসারিক প্রয়োজনের অনেক অসুবিধা । কিন্তু, সেদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে আমার আবরণ খসে পড়ল । মনে হল, সত্যকে মুক্ত দৃষ্টিতে দেখলুম। মানুষের অন্তরাত্মাকে দেখলুম । দুজন মুটে কাধে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে চলেছে । তাদের দেখে মনে হল, কী অনির্বচনীয় সুন্দর । মনে হল না, তারা মুটে । সেদিন তাদের অন্তরাত্মাকে দেখলুম, যেখানে আছে চিরকালের মানুষ । সুন্দর কাকে বলি । বাইরে যা অকিঞ্চিৎকর, যখন দেখি তার আন্তরিক অর্থ তখন দেখি সুন্দরকে । একটি গোলাপফুল বাছুরের কাছে সুন্দর নয় । মানুষের কাছে সে সুন্দর- যে মানুষ তার কেবল পাপড়ি না, বোটা না, একটা সমগ্ৰ আন্তরিক সার্থকতা পেয়েছে। পাবনার গ্রামবাসী কবি যখন প্রতিকল প্ৰণয়িনীর মানভঞ্জনের জন্যে ‘ট্যাহা দামের মোটরি” আনার প্রস্তাব করেন তখন মোটরির দাম এক টাকার চেয়ে অনেক বেড়ে যায় । এই মোটরি বা গোলাপের আন্তরিক অর্থটি যখন দেখতে পাই তখনই সে সুন্দর । সেদিন তাই আশ্চর্য হয়ে গেলুম । দেখলুম, সমস্ত সৃষ্টি অপরূপ । আমার এক বন্ধু ছিল, সে সুবুদ্ধির জন্যে বিশেষ বিখ্যাত ছিল না । তার সুবুদ্ধির একটু পরিচয় দিই। একদিন সে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, “আচ্ছা, ঈশ্বরকে দেখেছ ?” আমি বললুম, “না, দেখি নি তো ।” সে বললে, “আমি দেখেছি।” জিজ্ঞাসা করলুম, “কিরকম ।” সে উত্তর করলে, “কেন ? এই-যে চোখের কাছে বিজ বিজ করছে।” সে এলে ভাবতুম, বিরক্ত করতে এসেছে। সেদিন তাকেও ভালো লািগল । তাকে নিজেই ডাকলুম । সেদিন মনে হল, তার নিবুদ্ধিতাটা আকস্মিক, সেটা তার চরম ও চিরন্তন সত্য নয় । তাকে ডেকে সেদিন আনন্দ পেলুম । সেদিন সে “অমুক' নয় । আমি যার অন্তৰ্গত সেও সেই মানবলোকের অন্তৰ্গত । তখন মনে হল, এই মুক্তি । এই অবস্থায় চার দিন ছিলুম। চার দিন জগৎকে সত্যভাবে দেখেছি । তার পর জ্যোতিদা বললেন, “দাৰ্জিলিঙ চলো ।” সেখানে গিয়ে আবার পর্দা পড়ে গেল। আবার সেই অকিঞ্চিৎকরতা, সেই প্রাত্যহিকতা । কিন্তু, তার পূর্বে কয়দিন সকলের মাঝে র্যাকে দেখা গেল তার সম্বন্ধে আজ পর্যন্ত আর সংশয় রইল না । তিনি সেই অখণ্ড মানুষ যিনি মানুষের ভূত-ভবিষ্যতের মধ্যে পরিব্যাপ্ত— যিনি অরূপ, কিন্তু সকল মানুষের রূপের মধ্যে র্যার অন্তরতম আবির্ভাব ! ܔ সেই সময়ে এই আমার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা যাকে আধ্যাত্মিক নাম দেওয়া যেতে পারে । ঠিক সেই সময়ে বা তার অব্যবহিত পরে যে ভাবে আমাকে আবিষ্ট করেছিল তার স্পষ্ট ছবি দেখা যায় আমার সেই সময়কার কবিতাতে--- প্ৰভাতসংগীতের মধ্যে । তখন স্বতই যে ভােব আপনাকে প্ৰকাশ