পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দশম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

v9 (2 \\0 রবীন্দ্র-বচনাবলী না জানি কেন রে এত দিন পরে জাগিয়া উঠিল। প্ৰাণ ! জাগিয়া উঠেছে প্ৰাণ, ওরে উথলি উঠেছে বারি, ওরে প্রাণের বাসনা প্ৰাণের আবেগ রুধিয়া রাখিতে নারি । এটা হচ্ছে সেদিনকার কথা যেদিন অন্ধকার থেকে আলো এল বাইরের, অসীমের । সেদিন চেতনা নিজেকে ছাড়িয়ে ভূমার মধ্যে প্রবেশ করল । সেদিন করার দ্বার খুলে বেরিয়ে পড়বার জন্যে, জীবনে । সকল বিচিত্ৰ লীলার সঙ্গে যোগযুক্ত হয়ে প্রবাহিত হবার জন্যে অস্তরের মধ্যে তীব্র ব্যাকুলতা । সেই প্রবাহের গতি মহান বিরাট সমুদ্রের দিকে । তাকেই এখন বলেছি বিরাটপুরুষ । সেই-যে মহামানব তারই মধ্যে গিয়ে নদী মিলবে, কিন্তু সকলের মধ্য দিয়ে। এই-যে ডাক পড়ল, সূর্যের আলোতে জেগে মন ব্যাকুল হয়ে উঠল, এ আহবান কোথা থেকে । এর আকর্ষণ মহাসমুদ্রের দিকে, সমস্ত মানবের ভিতর দিয়ে, সংসারের ভিতর দিয়ে, ভোগ ত্যাগ কিছুই অস্বীকার করে নয়, সমস্ত স্পর্শ নিয়ে শেষে পডে এক জায়গায় যেখানে— কী জানি কী হল আজি, জাগিয়া উঠিল প্ৰাণ, দূর হতে শুনি যেন মহাসাগরের গান । সেই সাগরের পানে হৃদয় ছুটিতে চায়, তারি পদপ্রান্তে গিয়ে জীবন টুটিতে চায় । সেখানে যাওয়ার একটা ব্যাকুলতা অস্তরে জেগেছিল । মানবধর্ম সম্বন্ধে যে বক্তৃতা করেছি, সংক্ষেপে এই তার ভূমিকা | এই মহাসমুদ্রকে এখন নাম দিয়েছি মহামানব । সমস্ত মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে তিনি সৰ্ব্বজনের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত । তার সঙ্গে গিয়ে মেলবােরই এই ডাক । এর দু-চার দিন পরেই লিখেছি 'প্রভাত-উৎসব । একই কথা, আর-একটু স্পষ্ট করে লেখা হৃদয় আজি মোর কেমনে গেল খুলি ! জগত আসি সেথা করিছে কোলাকুলি । ধরায় আছে যত মানুষ শত শত আসিছে প্ৰাণে মোর, হাসিছে গলাগলি । এই তো সমস্তই মানুষের হৃদয়ের তরঙ্গলীলা । মানুষের মধ্যে স্নেহ-প্ৰেম-ভক্তির যে সম্বন্ধ সেটা তো আছেই । তাকে বিশেষ করে দেখা, বড়ো ভূমিকার মধ্যে দেখা, যার মধ্যে সে তার একটা ঐক্য, একটা তাৎপর্য লাভ করে । সেদিন যে-দুজন মুটের কথা বলেছি তাদের মধ্যে যে আনন্দ দেখলুম। সে সখের আনন্দ, অর্থাৎ এমন-কিছু যার উৎস সর্বজনীন সর্বকালীন চিত্তের গভীরে । সেইটে দেখেই খুশি হয়েছিলুম। আরো খুশি হয়েছিলুম। এইজন্যে যে, যাদের মধ্যে ঐ আনন্দটা দেখলুম তাদের বরাবর চােখে পড়ে না, তাদের অকিঞ্চিৎকর বলেই দেখে এসেছি ; যে মুহুর্তে তাদের মধ্যে বিশ্বব্যাপী প্ৰকাশ দেখলুম অমনি পরম সৌন্দর্যকে অনুভব করলুম। মানবসম্বন্ধের যে বিচিত্র রাসলীলা, আনন্দ, অনির্বচনীয়তা, তা দেখলুম। সেইদিন । সে দেখা বালকের কাচা লেখায় আকুবাকু করে নিজেকে প্ৰকাশ করেছে কোনোরকমে, পরিস্ফুট হয় নি । সে সময়ে আভাসে যা অনুভব করেছি। তাই লিখেছি। আমি। যে যা-খুশি গেয়েছি তা নয় । এ গান দু দণ্ডের নয়, এর অবসান নেই। এর একটা ধারাবাহিকতা আছে, এর অনুবৃত্তি আছে মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে । আমার গানের সঙ্গে সকল মানুষের যোগ আছে। গান থামলেও সে যোগ ছিন্ন হয় না ।