পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চণ্ডালিকা SR SRVO দ্বিতীয় দৃশ্য প্রকৃতি। বুক ফেটে যাবে ! আমি দেখব না। আয়না, দেখতে পারব না। কী ভয়ংকর দুঃখের ঘূর্ণিঝড়। বনস্পতি শেষকালে কি মড়মড় করে লুটােবে ধুলোয়, অভ্ৰভেদী গীেরর তার পড়বে CASINS ? মা। দেখ, বাছা, এখনো যদি বলিস, ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করি আমার মন্ত্রকে । তাতে আমার নাড়ী ছিড়ে যায়। যদি, যায় নিজের প্রাণ, সেও ভালো, কিন্তু ঐ মহাপ্ৰাণ রক্ষে পাক । প্রকৃতি । সেই ভালো, মা, থাক তোমার মন্ত্র। আর কােজ নেই।-- না না না না- পথ আর কতখানিই বা ! শেষ পর্যন্ত আসতে দে তাকে, আসতে দে, আমার এই বুকের কাছ পর্যন্ত । তার পরে সব দুঃখ দেব মিটিয়ে, আমার বিশ্বসংসার উজাড় করে দিয়ে। গভীর রাত্রে এসে পৌছবে পথিক, সমস্ত বুকের জ্বালা দিয়ে জ্বলিয়ে দেব প্রদীপ, আছে সুধার ঝরনা গভীর অন্তরে, তারি জলে অভিষেক হবে তার- যে শ্ৰান্ত, যে তপ্ত, যে ক্ষতবিক্ষত । আর-একবার সে চাইবে, জল দাও- আমার হৃদয়সমুদ্রের জল ! আসবে সেইদিন । তোর মন্ত্ৰ চলুক, চলুক । ዓijማ দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার, স্নান করাব অতল জলে বিপুল বেদনার । মোর সংসার দিব যে জ্বালি, শোধন হবে এ মোহের কালি, মরণব্যথা দিব তোমার চরণে উপহার । মা। এত দেরি হবে জানতুম না, বাছা । আমার মন্ত্র শেষ হল বুঝি । আমার প্রাণ যে কণ্ঠে 6Gi প্রকৃতি । ভয় নেই, মা, আর-একটু সয়ে থােক। একটুখানি । বেশি দেরি নেই। মা । আষাঢ় তো পড়েছে, ওঁদের চতুর্মাস্য তো আরম্ভ হল। প্রকৃতি । ওঁরা গেছেন বৈশালীতে গোশিরসংঘে । মা। কী নিষ্ঠুর তুই ! সে যে অনেক দূর । প্রকৃতি । বহুদূর নয় । সাত দিনের পথ। পনেরো দিন তো কেটে গেল। এতদিনে মনে হচ্ছে, টলেছে আসন, আসছে আসছে, যা বহুদূর, যা লক্ষযোজন দূর, যা চন্দ্ৰসূৰ্য পেরিয়ে, আমার দু হাতের নাগাল থেকে যা অসীম দূরে তাই আসছে কাছে। আসছে, কঁপিছে আমার বুক ভূমিকম্পে । মা। মন্ত্রের সব অঙ্গ পূর্ণ করেছি, এতে বজ্ৰপাণি ইন্দ্ৰকে আনতে পারত টেনে। তবু দেরি হচ্ছে। কী মরণান্তিক যুদ্ধই চলছে। কী দেখেছিলি তুই আয়নাতে । প্রকৃতি । প্রথম দেখেছি, আকাশজোড়া কুয়াশা, দৈত্যের সঙ্গে লড়াই করে ক্লান্ত দেবতার ফ্যাকাশে মুখের মতো । কুয়াশার ফাকে ফঁাকে বেরোচ্ছে আগুন । তার পরে কুয়াশাটা স্তবকে স্তবকে ছিড়ে ছিড়ে গেল- ফুলে-ওঠা ফেটে-পড়া প্ৰকাণ্ড বিষফোড়ার মতো- লাল হয়ে উঠল রঙ । সেদিন গেল । পরের দিন দেখি, পিছনে ঘন কালো মেঘ, বিদ্যুৎ খেলছে, সামনে দাড়িয়ে আছেন তিনি, জ্বলছে আগুন সর্বাঙ্গ ঘিরে । আমার রক্ত এল হিম হয়ে । ছুটে তোকে বলতে গেলুম, এখনি দে তোর মন্ত্র বন্ধ করে । গিয়ে দেখি তুই শিবনেত্র, কাঠের মতো বসে, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে, জ্ঞান নেই। মনে হল, তোর মধ্যেও কোনোখানে দাউ-দাউ জ্বলছে আগুন । যে পাবক দিয়ে তিনি ঢেকেছেন। আপনাকে তোর অগ্নিনাগিনী ফোস ফোস করে তাকে ছোবল মারছে, চলছে দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ফিরে এসে আয়না তুলে দেখি, আলো গেছে- শুধু দুঃখ দুঃখ দুঃখ, অসীম দুঃখের মূর্তি।