পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৩৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চণ্ডালিকা w- RR 6 সামনে যেন বস্তু নেই ; নেই সত্যমিথ্যা, নেই ভালোমন্দ ; আছে চিন্তাহীন অন্ধ লক্ষ্য, নেই তার কোনো অর্থ । মা । আজ কোথায় এসেছেন আন্দাজ করতে পারিস ? প্রকৃতি । কাল সন্ধ্যার সময় দেখেছি উপলী নদীর ধারে পাটল গ্রামে। নববর্ষায় জলের ধারা উন্মত্ত, ঘাটের কাছে পুরোনো পিপুল গাছ, জোনাকি জ্বলছে ডালে ডালে, তলায় শেওলা-ধরা বেদীসেইখানে এসেই হঠাৎ চমকে দাড়ালেন । অনেকদিনের চেনা জায়গা ; শুনেছি, ঐখানে বসে ভগবান বুদ্ধ একদিন রাজা সুপ্ৰভাসকে উপদেশ দিয়েছিলেন । দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লেন, স্বপ্ন বুঝি ভাঙল হঠাৎ । তখনি ছুড়ে ফেলে দিলেম আয়না, ভয় হল কী জানি কী দেখব । তার পরে গেছে সমস্তদিন, কিছু জানতে চাই নি, আশা করছি, আশা ছাড়ছি- এমনি করে আছি বসে। এখন রাত আসছে। অন্ধকার হয়ে । প্রহরী হাক দিয়ে চলেছে রাস্তায়, এক প্রহর গেল বুঝি কেটে ! আর সময় নেই, সময় নেই, মা, এ রাত ব্যর্থ করিস নে । তোর সব জোরটা দে ঐ মন্ত্রে । মা । আর পারছি নে, বাছা । মন্ত্র দুর্বল হয়ে এল, আমার প্রাণ ও শরীর এসেছে। অবশ হয়ে । প্রকৃতি । দুর্বল হলে চলবে না । দিস নে হাল ছেড়ে । ফেরবার দিকে মুখ ফিরিয়েছেন বা, বাধনে শেষ টান পড়েছে- হয়তো টিকবে না । হয়তো বেরিয়ে যাবেন আমার এ জন্মের সংসার থেকে, আর পাব না। নাগাল কিছুতেই। তখন আমারই স্বপ্নের পালা, আবার চণ্ডালিনীর মায়ামূর্তি। পারব না। সইতে সেই মিথ্যে । পায়ে পড়ি, মা, দে একবার তোর সমস্ত শক্তি । এবার শুরু করা তোর বসুন্ধরামন্ত্র, টলতে থাক পুণ্যবানদের তুষিত স্বৰ্গলোক । 5R আমি তোমারি মাটির কন্যা, জননী বসুন্ধরা । তবে আমার মানবজন্ম কেন বঞ্চিত করা । পবিত্র জানি যে তুমি পবিত্র জন্মভূমিমানবকন্যা আমি যে ধন্যা প্ৰাণের পুণ্যে ভরা । কোন স্বর্গের তরে ওরা তোমায় তুচ্ছ করে, রহি তোমার বক্ষ-’পরে । আমি যে তোমারি আছি নিতান্ত কাছাকাছিতোমার মোহিনীশক্তি দাও আমারে হৃদয়প্ৰাণ-হর । মা । যেমন বলেছিলেম তেমনি প্ৰত্তত হয়েছ তো ? প্ৰকৃতি । হয়েছি ! কাল ছিল শুক্লাদ্বিতীয়ার রাত, করেছি গভীরায় অবগাহন স্নান । এই তো চাল দিয়ে, দাড়িমের ফুল দিয়ে, সিঁদুর দিয়ে, সাতটি রত্ন দিয়ে, চক্র এঁকেছি আঙিনায় । পুতেছি হলদে কাপড়ের ধ্বজাগুলি, থালায় রেখেছি মােলাচন্দন, জ্বালিয়েছি বাতি । স্নানের পর কাপড় পরেছি। ধানের অন্ধুরের রঙ, চাপার রঙের ওড়না। পূব দিকে আসন করে সমস্ত রাত ধ্যান করেছি। তার মূর্তি । ষোলোটি সোনালি সুতোয় ষোলোটি গ্রন্থি দিয়ে রাখী পরেছি বা হাতে ।