পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রবীন্দ্র-রচনাবলী 418 ܓ রহস্যভেদ করতে হার মানেন স্বয়ং নারীর সৃষ্টিকর্তা পর্যন্ত, কিন্তু তুমি নারীচরিত্রচারণচক্রবর্তী, নমস্কার তোমাকে | ক্ষিতীশ । (করজোড়ে) বন্দনা। সারা হল, এবার বর্ণনার পালা শুরু হােক । বঁাশরি। এটা আন্দাজ করতে পার নি যে, সুষমা ঐ সন্ন্যাসীর ভালোবাসায় একেবারে শেষ-পর্যন্ত তলিয়ে গেছে ? A. ক্ষিতীশ । ভালোবাসা না ভক্তি ? বঁাশরি। চরিত্রবিশারদ, লিখে রাখো, মেয়েদের যে ভালোবাসা পৌঁছয় ভক্তিতে সেটা তাদের মহাপ্ৰয়াণ- সেখান থেকে ফেরবার রাস্তা নেই। অভিভূত যে পুরুষ ওদের সমান প্ল্যাটফরমে নামে সেই গরিবের জন্য থার্ড ক্লাস, বড়ো জোর ইন্টার-মীডিয়েট । সেলুনগাড়ি তো নয়ই। যে উদাসীন মেয়েদের মোহে হার মানল না, ওদের ভূজপাশের দিগবলয় এড়িয়ে যে উঠল। মধ্যগগনে, দুই হাত উর্ধের্ব তুলে মেয়েরা তারই উদ্দেশে দিল শ্রেষ্ঠ নৈবেদ্য । দেখ নি তুমি, সন্ন্যাসী যেখানে মেয়েদের সেখানে কী ঠেলা ঠেলি ভিড় । ক্ষিতীশ । তা হবে । কিন্তু তার উলটোটাও দেখেছি । মেয়েদের বিষম টান একেবারে তাজা বর্বরের প্ৰতি । পুলকিত হয়ে ওঠে তাদের অপমানের কঠোরতায়, পিছন পিছন রসাতল পর্যন্ত যেতে রাজি । বঁশরি । তার কারণ মেয়েরা অভিসারিকার জাত । এগিয়ে গিয়ে যাকে চাইতে হয় তার দিকেই ওদের পুরো ভালোবাসা । ওদের উপেক্ষা তারই পরে দুৰ্বত্ত হবার মতো জোর নেই। যার কিংবা দুর্লভ হবার মতো তপস্যা । ক্ষিতীশ । আচ্ছা, বোঝা গেল সন্ন্যাসীকে ভালোবাসে ঐ সুষমা । তার পরে ? বঁশরি ; সে কী ভালোবাসা । মরণের বাড়া ! সংকোচ ছিল না, কেননা একে সে ভক্তি বলেই জানত । পুরন্দর দূরে যেত আপন কাজে, সুষমা তখন যেত শুকিয়ে, মুখ হয়ে যেত ফ্যাকাশে । চোখে প্রকাশ পেত জ্বালা, মন শূন্যে শূন্যে খুঁজে বেড়াত কার দর্শন। বিষম ভাবনা হল মায়ের মনে । একদিন আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বাশি, কী করি । আমার বুদ্ধির উপর তখন তার ভরসা ছিল । আমি বললেম, “দাও-না পুরন্দরের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ।” তিনি তো আঁৎকে উঠলেন ; বললেন, “এমন কথা ভাবতেও পার ? তখন নিজেই গেলুম পুরন্দরের কাছে। সোজা বললুম, “নিশ্চয়ই জানেন, সুষমা আপনাকে ভালোবাসে। ওকে বিয়ে করে উদ্ধার করুন বিপদ থেকে ’ এমন করে মানুষটা তাকাল আমার মুখের দিকে, রক্ত জল হয়ে গেল। গভীর সুরে বললে, “সুষমা। আমার ছাত্রী, তার ভার আমার ’পরে আর আমার ভার তোমার পরে নয়।” পুরুষের কাছ থেকে এতবড়ো ধাক্কা জীবনে এই প্ৰথম । ধারণা ছিল, সব পুরুষের পরেই সব মেয়ের আবদার চলে, যদি নিঃসংকোচ সাহস থাকে। দেখলুম। দুৰ্ভেদ্য দুৰ্গও আছে। মেয়েদের সাংঘাতিক বিপদ সেই বন্ধ কপাটের সামনে, ডাকও আসে” সেইখান থেকে, কপালাও ভাঙে সেইখানটায় । ক্ষিতীশ । আচ্ছা বাশি, সত্যি করে বলো, সন্ন্যাসী তোমারও মনকে টেনেছিল। কিনা । বঁাশরি। দেখো, সাইকলজির অতি সূক্ষ্ম তত্ত্বের মহলে কুলুপ দেওয়া ঘর। নিষিদ্ধ দরজা না খোলাই ভালো ; সন্দরমহলেই যথেষ্ট গোলমাল, সামলাতে পারলে বাচি । আজ যে-পর্যন্ত শুনলে তার পরের অধ্যায়ের বিবরণ পাওয়া যাবে একখানা চিঠি থেকে । পরে দেখাব । ক্ষিতীশ । ঘরের মধ্যে চেয়ে দেখো, বাঁশি । পুরন্দর আঙটি বদল করাচ্ছে। জানলার থেকে সুষমার মুখের উপর পড়েছে রোদের রেখা । স্তবন্ধ হয়ে বসে আছে, শান্ত মুখ, জল ঝরে পড়ছে দুই চোখ দিয়ে। বরফের পাহাড়ে যেন সূর্যস্ত, গলে পড়ছে ঝরনা । ইবাশরি। সোমশংকরের মুখের দিকে দেখে-সুখ না। দুঃখ, বাধন পরছে না ছিড়ছে ? আর পুরন্দর, সে যেন ঐ সূর্যেরই আলো । তার বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রয়েছে লক্ষ যোজন দূরে, মেয়েটার মনে যে অগ্নিকাণ্ড চলছে তার সঙ্গে কোনো যোগই নেই। অথচ তাকে ঘিরে একটা জ্বলন্ত ছবি বানিয়ে দিলে । ক্ষিতীশ । সুষমার পরে সন্ন্যাসীর মন এতই যদি নির্লিপ্ত তবে ওকেই বেছে নিলে কেন ।