পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/২৯৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Sዔbr রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী বঁাশরি। এই সেই চিঠি । সন্ন্যাসী বলছেন- প্রেমে মানুষের মুক্তি সর্বত্র । কবিরা যাকে বলে ভালোবাসা সেইটাই বন্ধন । তাতে একজন মানুষকেই আসক্তির দ্বারা ঘিরে নিবিড় স্বাতন্ত্র্যে অতিকৃত করে ; প্রকৃতি রঙিন মদ ঢেলে দেয় দেহের পাত্রে, তাতে যে মাতলামি তীব্র হয়ে ওঠে তাকে অপ্ৰমত্ত সত্যবোধের চেয়ে বেশি সত্য বলে ভুল হয় । খাচাকেও পাখি ভালোবাসে যদি তাকে আফিমের নেশার বশ করা যায়। সংসারের যত দুঃখ, যত বিরোধ, যত বিকৃতি সেই মায়া নিয়ে যাতে শিকলকে করে লোভনীয়। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যে চিনতে যদি চাও তবে বিচার করে দেখো কোনটাতে ছাড়া দেয়। আর কোনটা রাখে বেঁধে । প্রেমে মুক্তি, ভালোবাসায় বন্ধন । ক্ষিতিশ । শুনলেম চিঠি, তার পরে ? বাশরি । তার পরে তোমার মাথা ! অর্থাৎ তোমার কল্পনা । মনে মনে শুনতে পােচ্ছ না ? শিষ্যকে বলছেন, ভালোবাসা আমাকে নয়, অন্য কাউকেও নয় । নির্বিশেষ প্ৰেম, নির্কিকার আনন্দ, নিরাসক্ত আত্মনিবেদন, এই হল দীক্ষামন্ত্র । ক্ষিতিশ । তা হলে এর মধ্যে সোমশংকর আসে কোথা থেকে । বঁশরি । প্রেমের সরকারী রাস্তায়, যে প্রেমে সকলেরই সমান অধিকার খোলা হাওয়ার মতো । তুমি লেখকপ্রবর, তোমার সামনে সমস্যাটা এই যে, খোলা হাওয়ায় সোমশংকরের পেট ভরবে কি । ক্ষিতিশ। কী জানি । সূচনায় তো দেখতে পাচ্ছি শূন্যপুরাণের পালা । বঁাশরি। কিন্তু, শূন্যে এসে কি ঠেকতে পারে কিছু। শেষ মোকামে তো পৌঁছল গাড়ি, এ-পর্যন্ত রথ চালিয়ে এলেন সন্ন্যাসীসারথি ! আডিডা-বদলের সময় যখন একদিন আসবে তখন লগােম পড়বে কার হাতে । সেই কথাটা বলো না রিয়ালিসট ? ক্ষিতিশ। যাকে ওঁরা নাক সিটিকে প্রকৃতি বলেন, সেই মায়াবিনীর হাতে । পাখা নেই। অথচ আকাশে উড়তে চায় যে স্কুল জীবটা তাকে যিনি ধাপ করে মাটিতে ফেলে চট্টকা দেন ভাঙিয়ে, সঙ্গে সঙ্গে সর্বাঙ্গে লাগিয়ে দেন। ধুলো | 7 বঁাশরি। প্রকৃতির। সেই বিদ্রুপটািকেই বর্ণনা করতে হবে তোমাকে । ভবিতব্যের চেহারাটা জোর কলমে দেখিয়ে দাও । বড়ো নিষ্ঠুর । সীতা ভাবলেন, দেবচরিত্র রামচন্দ্ৰ উদ্ধার করবেন। রাবণের হাত থেকে ; শেষকালে মানবপ্রকৃতি রামচন্দ্র চাইলেন তঁাকে আগুনে পোড়াতে । একেই বলে রিয়ালিজম, নোঙরামিকে নয় । লেখো লেখো, দেরি কোরো না, লেখো। এমন ভাষায় যা হৃৎপিণ্ডের শিরাছেড়া ভাষা । পাঠকেরা চমকে উঠে দেখুক, এতদিন পরে বাংলার দুর্বল সাহিত্যে এমন একটা লেখা ফেটে বেরোল যা ঝোড়ো মেঘের বুকভাঙা সূর্যাস্তের রাগী আলোর মতো । ক্ষিতিশ। ইস, তোমার মনটা নেমেছে ভলক্যানের জঠরাগ্নির মধ্যে । একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, ওদের অবস্থায় পড়লে কী করতে তুমি । বঁাশরি । সন্ন্যাসীর উপদেশ সোনার জলে বাধানো খাতায় লিখে রাখতুম । তার পরে প্রবৃত্তির জোর কলমে তার প্রত্যেক অক্ষরের উপর দিতুম কালির আঁচড় কেটে । প্রকৃতি জাদু লাগায় আপন মস্ত্রে, সন্ন্যাসীও জাদু করতেই চায় উলটাে মন্ত্রে । ওর মধ্যে একটা মন্ত্র নিতুম মাথায়, আর-একটা মন্ত্রে প্রতিদিন প্ৰতিবাদ করতুম হৃদয়ে । ক্ষিতিশ । এখন কাজের কথা পাড়া যাক । ইতিহাসের গোড়ার দিকটায় ফাক রয়েছে। ওদের বিবাহসম্বন্ধ সন্ন্যাসী ঘটােল কী উপায়ে । বাশরি । প্রথমত সেনবিংশ যে ক্ষত্রিয়, সেনানী শব্দ থেকে তার পদবীর উদ্ভব, ওরা যে কোনো-কএ খ্রীস্ট-শতাব্দীতে এসেছিল কোনো-এক দক্ষিণপ্রদেশ থেকে দিগ বিজয়ীবাহিনীর পতাকা নিয়ে বাংলার কোনো-এক বিশেষ বিভাগে, সেইটে প্রমাণ করে লিখল এক সংস্কৃত পুঁথি । কাশীর দ্রাবিড়ী পণ্ডিত করলে তার সমর্থন । সন্ন্যাসী স্বয়ং গেল সোমশংকরদের রাজ্যে । প্ৰজারা ইয়া করে রইল ওর চেহারা দেখে ; কানাকানি করতে লাগল, কোনো-একটা দেব-অংশের ঝালাই দিয়ে এর দেহখানা তৈরি । সভাপণ্ডিত মুগ্ধ হল শৈবদর্শনব্যাখ্যায়। রাজাবাহাদুরের মনটা সাদা, দেহটা জোরালো, তাতে লাগল