পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NOONQ রবীন্দ্র-রচনাবলী তাহার নিজের মধ্যে একটি পুরুষোচিত প্ৰভুশক্তি আছে তাহাও প্রকাশ করিতে পারিল না, আর প্রেমের সামগ্ৰীকে নানা উপকরণে ঐশ্বৰ্যবান করিয়া তুলিবার যে ইচ্ছা তাহাও তার পূর্ণ হইতেছে না । এমনি করিয়াই এই ধনীর সন্তান তাহার মানমর্যাদা, তাহার সুন্দরী স্ত্রী, তাহার ভরা যৌবনসাধারণত লোকে যাহা কামনা করে তাহার সমস্ত লইয়াও সংসারে একদিন একটা উৎপাতের মতো হইয়া উঠিল । সুখদা মধুকৈবর্তের স্ত্রী, মনোহরলালের প্রজা । সে একদিন অন্তঃপুরে আসিয়া কিরণলেখার পা জড়াইয়া ধরিয়া কান্না জুড়িয়া দিল । ব্যাপারটা এই— বছর কয়েক পূর্বে নদীতে বেড়জাল ফেলিবার আয়োজন-উপলক্ষে অন্যান্য বারের মতো জেলেরা মিলিয়া এক যোগে খৎ লিখিয়া মনোহরলালের কাছারিতে হাজার টাকা ধার লইয়াছিল । ভালোমত মাছ পড়িলে সুদে আসলে টাকা শোধ করিয়া দিবার কোনো অসুবিধা ঘটে না ; এইজন্য উচ্চ সুদের হারে টাকা লইতে ইহারা চিন্তামাত্র করে না । সে বৎসর তেমন মাছ পড়িল না এবং ঘটনাক্রমে উপরি উপরি তিন বৎসর নদীর বঁাকে মাছ। এত কম আসিল যে, জেলেদের খরচ পোষাইল না, অধিকন্তু তাহারা ঋণের জালে বিপরীত রকম জড়াইয়া পড়িল । যে-সকল জেলে ভিন্ন এলেকার, তাহাদের আর দেখা পাওয়া যায় না ; কিন্তু, মধুকৈবর্ত ভিটাবাড়ির প্রজা, তাহার পলাইবার জো নাই বলিয়া সমস্ত দেনার দায় তাহার উপরেই চাপিয়াছে। সর্বনাশ হইতে রক্ষা পাইবার অনুরোধ লইয়া সে কিরণের শরণাপন্ন হইয়াছে। কিরণের শাশুড়ির কাছে গিয়া কোনো ফল নাই তাহা সকলেই জানে ; কেননা নীলকণ্ঠের ব্যবস্থায় কেহ যে আঁচড়টুকু কাটিতে পারে, এ কথা তিনি কল্পনা করিতেও পারেন না । নীলকণ্ঠের প্রতি বনোয়ারির খুব একটা আক্রোশ আছে জানিয়াই মধুকৈবর্ত তাহার স্ত্রীকে কিরণের কাছে পাঠাইয়াছে। বনোয়ারি যতই রাগ এবং যতই আম্ফালন করুক, কিরণ নিশ্চয় জানে যে, নীলকণ্ঠের কাজের উপর হস্তক্ষেপ করিবার কোনো অধিকার তাহার নাই। এইজন্য কিরণ সুখদাকে বার বার করিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করিয়া বলিল, “বাছা, কী করব বলো | জানই তো এতে আমাদের কোনো হাত নাই | কর্তা আছেন, মধুকে বলো, তাকে গিয়ে ধরুক ।” সে চেষ্টা তো পূর্বেই হইয়াছে। মনোহরলালের কাছে কোনো বিষয়ে নালিশ উঠিলেই তিনি তাহার বিচারের ভার নীলকণ্ঠের পরেই অপণ করেন, কখনোই তাহার অন্যথা হয় না । ইহাতে বিচারপ্রার্থীর বিপদ আরো বাড়িয়া উঠে । দ্বিতীয়বার কেহ যদি তাহার কাছে আপিল করিতে চায় তাহা হইলে কর্তা রাগিয়া আগুন হইয়া উঠেন- বিষয়াকর্মের বিরক্তিই যদি তাহাকে পোহাইতে হইল। তবে বিষয় ভোগ করিয়া তাহার সুখ কী । সুখদা যখন কিরণের কাছে কান্নাকাটি করিতেছে তখন পাশের ঘরে বসিয়া বনোয়ারি তাহার বন্দুকের চোঙে তেল মাখাইতেছিল। বনোয়ারি সব কথাই শুনিল । কিরণ করুণকণ্ঠে যে বার বার * যে, তাহারা ইহার কোনো প্ৰতিকার করিতে অক্ষম, সেটা বনোয়ারির বুকে শেলের rGNO rata | সেদিন মাঘীপূর্ণিমা ফায়ুনের আরম্ভে আসিয়া পড়িয়াছে। দিনের বেলাকার গুমটি ভাঙিয়া সন্ধ্যাবেলায় হঠাৎ একটা পাগলা হাওয়া মাতিয়া উঠিল । কোকিল তো ডাকিয়া ডাকিয়া অস্থির ; বার বার এক সুরের আঘাতে সে কোথাকার কোন ঔদাসীন্যকে বিচলিত করিবার চেষ্টা করিতেছে। আর, আকাশে ফুলগন্ধের মেলা বসিয়াছে, যেন ঠেলাঠেলি ভিড় ; জানলার ঠিক পাশেই অন্তঃপুরের বাগান হইতে মুচুকুন্দযুলের গন্ধ বসন্তের আকাশে নিবিড় নেশা ধরাইয়া দিল। কিরণ সেদিন লাটুকানের রঙ-করা একখানি শাড়ি এবং খোপায় বেলফুলের মালা পরিয়াছে। এই দম্পতির চিরনিয়ম অনুসারে সেদিন বনােয়ারির জন্যও ফাঙ্গুনি-ঋতুযাপনের উপযোগী একখানি লাটুকানে-রঙিন চাদর ও বেলফুলের গড়েমালা প্ৰস্তুত । রাত্রির প্রথম প্রহর কাটিয়া গেল তবু বনোয়ারির দেখা নাই। যৌবনের ভরা পেয়ালাটি আজ তাহার কাছে কিছুতেই রুচিল না। প্রেমের বৈকুণ্ঠলোকে এতবড়ো কুষ্ঠা লইয়া সে