পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se Vo প্ৰবেশ করিবে কেমন করিয়া । মধুকৈবর্তের দুঃখ দূর করিবার ক্ষমতা তাহার নাই, সে ক্ষমতা আছে নীলকণ্ঠের ! এমন কাপুরুষের কণ্ঠে পরাইবার জন্য মালা কে গাথিয়াছে। প্ৰথমেই সে তাহার বাহিরের ঘরে নীলকণ্ঠকে ডাকাইয়া আনিল এবং দেনার দায়ে মধুকৈবর্তকে নষ্ট করিতে নিষেধ করিল । নীলকণ্ঠ কহিল, মধুকে যদি প্রশ্ৰয় দেওয়া হয় তাহা হইলে এই তােমাদির মুখে বিস্তর টাকা বাকি পড়িবে ; সকলেই ওজর করিতে আরম্ভ করিবে । বনোয়ারি তর্কে যখন পারিল না। তখন যাহা মুখে আসিল গাল দিতে লাগিল । বলিল, ছোটােলোক । নীলকণ্ঠ কহিল, “ছোটােলোক না। হইলে বড়োলোকের শরণাপন্ন হইব কেন।” বলিল, চোর। নীলকণ্ঠ বলিল, “সে তো বটেই, ভগবান যাহাকে নিজের কিছুই দেন নাই, পরের ধনেই তো সে প্ৰাণ বাচায়।” সকল গালিই সে মাথায় করিয়া লাইল ; শেষকালে বলিল, “উকিলবাবু বসিয়া আছেন, তাহার সঙ্গে কাজের কথাটা সারিয়া লই । যদি দরকার বোধ করেন তো আবার আসিব ।” বনোয়ারি ছোটো ভাই বংশীকে নিজের দলে টানিয়া তখনই বাপের কাছে যাওয়া স্থির করিল । সে জানিত, একলা গেলে কোনো ফল হইবে না, কেননা, এই নীলকণ্ঠকে লইয়াই তাহার বাপের সঙ্গে পূর্বেই তাহার খিটমিটি হইয়াছে। বাপ তাহার উপর বিরক্ত হইয়াই আছেন। একদিন ছিল যখন সকলেই মনে করিত মনোহরলাল তাহার বড়ো ছেলেকেই সব চেয়ে ভালোবাসেন । কিন্তু, এখন মনে হয়, বংশীর উপরেই তাহার পক্ষপাত । এইজন্যই বনোয়ারি বংশীকেও তাহার নালিশের পক্ষভুক্ত क८िऊ फ्रिशिक्षणी । বংশী, যাহাকে বলে, অত্যন্ত ভালো ছেলে । এই পরিবারের মধ্যে সে-ই কেবল দুটো একজামিন পাস করিয়াছে। এবার সে আইনের পরীক্ষা দিবার জন্য প্ৰস্তুত হইতেছে । দিনরাত জাগিয়া পড়া করিয়া করিয়া তাহার অন্তরের দিকে কিছু জমা হইতেছে কি না। অন্তৰ্যামী জানেন কিন্তু শরীরের দিকে খরচ ছাড়া আর কিছুই নাই । এই ফায়ুনের সন্ধ্যায় তাহার ঘরে জানলা বন্ধ । ঋতুপরিবর্তনের সময়টাকে তাহার ভারি ভয় । হাওয়ার প্রতি তাহার শ্রদ্ধামাত্র নাই । টেবিলের উপর একটা কেরোসিনের, ল্যাম্প জ্বলিতেছে । কতক বই মেজের উপরে চৌকির পাশে রাশীকৃত, কতক টেবিলের উপরে ; দেয়ালে কুলুঙ্গিতে কতগুলি ঔষধের শিশি । År বনোয়ারির প্রস্তাবে সে কোনোমতেই সম্মত হইল না । বনোয়ারি রাগ করিয়া গর্জিয়া উঠিল, “তুই নীলকণ্ঠকে ভয় করিস !” বংশী তাহার কোনো উত্তর না দিয়া চুপ করিয়া রহিল । বস্তুতই নীলকণ্ঠকে অনুকূল রাখিবার জন্য তাহার সর্বদাই চেষ্টা । সে প্রায় সমস্ত বৎসর কলিকাতার বাসাতেই কাটায় ; সেখানে বরাদ্দ টাকার চেয়ে তাহার বেশি দরকার হইয়াই পড়ে। এই সূত্রে নীলকণ্ঠকে প্ৰসন্ন রাখাটা তাহার অভ্যন্ত । বংশীকে ভীরু, কাপুরুষ, নীলকণ্ঠের চরণ-চারণ-চক্রবতী বলিয়া খুব একচেটি গালি দিয়া বনোয়ারি একলাই বাপের কাছে গিয়া উপস্থিত । মনোহরলাল তঁহাদের বাগানে দিঘির ঘাটে তাহার নধর শরীরটি উদঘাটন করিয়া আরামে হাওয়া খাইতেছেন । পারিষদগণ কাছে বসিয়া কলিকাতার বারিস্টারের জেরায় জেলাকেটে অপর পল্লীর জমিদার অখিল মজুমদার যে কিরাপ নাকাল হইয়াছিল। তাহারই কাহিনী কর্তবাবুর শ্রুতিমধুর করিয়া রচনা করিতেছিল। সেদিন বসন্তসন্ধ্যার সুগন্ধ বায়ুসহযোগে সেই বৃত্তান্তটি তাহার কাছে অত্যন্ত রমণীয় হইয়া উঠিয়াছিল । হঠাৎ বনোয়ারি তাহার মাঝখানে পড়িয়া রাসভঙ্গ করিয়া দিল। ভূমিকা করিয়া নিজের বক্তব্য কথাটা ধীরে ধীরে পাড়িবার মতো অবস্থা তাহার ছিল না । সে একেবারে গলা চড়াইয়া শুরু করিয়া দিল, নীলকণ্ঠের দ্বারা তাহদের ক্ষতি হইতেছে। সে চোর, সে মনিবের টাকা ভাঙিয়া নিজের পেট ভরিতেছে। কথাটার কোনো প্ৰমাণ নাই এবং তাহা সত্যও নহে। নীলকণ্ঠের দ্বারা বিষয়ের উন্নতি হইয়াছে, এবং সে চুরিও করে না । বনোয়ারি মনে করিয়াছিল, নীলকণ্ঠের সৎস্বভাবের প্রতি অটল বিশ্বাস আছে বলিয়াই কর্তা সকল বিষয়েই তাহার পরে এমন চোখ বুজিয়া নির্ভর করেন । এটা তাহার