পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

OO 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী ভ্ৰম । মনোহরলালের মনে নিশ্চয় ধারণা যে নীলকণ্ঠ সুযোগ পাইলে চুরি করিয়া থাকে । কিন্তু, সেজন্য তাহার প্রতি তাহার কোনো অশ্রদ্ধা নাই । কারণ, আবহমানকাল এমনি ভাবেই সংসার চলিয়া আসিতেছে । অনুচরগণের চুরির উচ্ছিষ্টেই তো চিরকাল বড়োঘর পালিত । চুরি করিবার চাতুরী যাহার নাই, মনিবের বিষয়ারক্ষা করিবার বুদ্ধিই বা তাহার জোগাইবে কোথা হইতে । ধৰ্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দিয়া তো জমিদারির কাজ চলে না । মনোহর অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিয়া কহিলেন, “আচ্ছা, আচ্ছা, নীলকণ্ঠ কী করে না-করে সে কথা তোমাকে ভাবিতে হইবে না ।” সেইসঙ্গে ইহাও বলিলেন, “দেখো দেখি, বংশীর তো কোনো বালাই নাই। সে কেমন পড়াশুনা করিতেছে । ঐ ছেলেটা তবু একটু মানুষের মতো ।” ইহার পরে অখিল মজুমদারের দুৰ্গতিকাহিনীতে আর রস জমিল না । সুতরাং, মনোহরলালের পক্ষে সেদিন বসন্তের বাতাস বৃথা বহিল এবং দিঘির কালো জলের উপর চাদের আলোর ঝকঝাঁক করিয়া উঠিবার কোনো উপযোগিতা রহিল না । সেদিন সন্ধ্যাটা কেবল বৃথা হয় নাই বংশী এবং নীলকণ্ঠের কাছে । জানলা বন্ধ করিয়া বংশী অনেক রাত পর্যন্ত পড়িল এবং উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া নীলকণ্ঠ অর্ধেক রাত কাটাইয়া দিল । কিরণ ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়া জানলার কাছে বসিয়া । কাজকর্ম আজ সে সকাল-সকাল সারিয়া লইয়াছে । রাত্রের আহার বাকি, কিন্তু এখনো বনোয়ারি খায় নাই, তাই সে অপেক্ষা করিতেছে ; মধুকৈবর্তের কথা তাহার মনেও নাই । বনোয়ারি যে মধুর দুঃখের কোনো প্ৰতিকার করিতে পারে না, এ সম্বন্ধে কিরণের মনে ক্ষোভের লেশমাত্র ছিল না । তাহার স্বামীর কাছ হইতে কোনোদিন সে কোনো বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় পাইবার জন্য উৎসুক নহে। পরিবারের গৌরবেই তাহার স্বামীর গৌরব । তাহার স্বামী তাহার শ্বশুরের বড়োছেলে, ইহার চেয়ে তাহাকে যে আরো বড়ো হইতে হইবে, এমন কথা কোনোদিন তাহার মনেও হয় নাই । ইহারা যে গোসাইগঞ্জের সুবিখ্যাত হালদার-বংশ ! বনোয়ারি অনেক রাত্রি পর্যন্ত বাহিরের বারান্ডায় পায়চারি সমাধা করিয়া ঘরে আসিল । সে ভুলিয়া গিয়াছে যে, তাহার খাওয়া হয় নাই । কিরণ যে তাহার অপেক্ষায় না-খাইয়া বসিয়া আছে। এই ঘটনাটা সেদিন যেন তাহাকে বিশেষ করিয়া আঘাত করিল । কিরণের এই কষ্টস্বীকারের সঙ্গে তাহার নিজের অকমণ্যতা যেন খাপ খাইল না । অন্নের গ্রাস তাহার গলায় বাধিয়া যাইবার জো হইল । বনোয়ারি অত্যন্ত উত্তেজনার সহিত স্ত্রীকে বলিল, “যেমন করিয়া পারি। মধুকৈবর্তকে আমি রক্ষা করিব।” কিরণ ভুয় এই অনাবশ্যক উপাতায় বিস্মত হইয়া কহিল,"শোনাে একবার ! তুমি তাহাকে বঁাচাইবে কেমন " মধুর দেনা বনোয়ারি নিজে শোধ করিয়া দিবে। এই তাহার পণ, কিন্তু বনোয়ারির হাতে কোনোদিন তো টাকা জমে না । স্থির করিল, তাহার তিনটে ভালো বন্দুকের মধ্যে একটা বন্দুক এবং একটা দামি হীরার আংটি বিক্রয় করিয়া সে অর্থ সংগ্ৰহ করিবে । কিন্তু, গ্রামে। এ-সব জিনিসের উপযুক্ত মূল্য জুটিবে না এবং বিক্রয়ের চেষ্টা করিলে চারি দিকে লোকে কানাকানি করিবে । এইজন্য কোনো একটা ছুতা করিয়া বনোয়ারি কলিকাতায় চলিয়া গেল। যাইবার সময় মধুকে ডাকিয়া আশ্বাস দিয়া গেল, তাহার কোনো ভয় নাই । এ দিকে বনোয়ারির শরণাপন্ন হইয়াছে বুঝিয়া, নীলকণ্ঠ মধুর উপরে রাগিয়া আগুন হইয়া উঠিয়াছে । পেয়াদার উৎপীড়নে কৈবর্তপাড়ার আর মানসম্রাম থাকে না । কলিকাতা হইতে বনোয়ারি যেদিন ফিরিয়া আসিল সেই দিনই মধুর ছেলে স্বরূপ হঁপাইতে হাঁপাইতে দুটিয়া আসিয়া একেবারে বনোয়ারির পা জড়াইয়া ধরিয়া হাউহাউ করিয়া কান্না জুড়িয়া দিল । “কী রে কী, ব্যাপারখানা কী ” স্বরূপ বলিল তাহার ব্যাপকে নীলকণ্ঠ কাল রাত্ৰি হইতে কাছারিতে বন্ধ করিয়া রাখিয়াছে । বনোয়ারির সর্বশরীর রাগে কাপিতে লাগিল ; কহিল, “এখনি গিয়া থানায় খবর দিয়া আয় গে৷ ”