পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩২৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

set Ood মৃত্যুর পূর্বে মনোহর বিশেষ করিয়া তাহার ক্ষুদ্র এই বংশধরকে কিরণ এবং নীলকণ্ঠের হাতে সমর্পণ করিয়া গেলেন ; বনোয়ারিকে কোনো কথাই বলিলেন না । বাক্স হইতে উইল যখন বাহির হইল তখন দেখা গেল, মনোহর তাহার সমস্ত সম্পত্তি হরিদাসকে দিয়া গিয়াছেন। বনোয়ারি যাবজীবন দুই শত টাকা করিয়া মাসহায়া পাইবেন । নীলকণ্ঠ উইলের একজিকাটর, তাহার উপরে ভার রহিল, সে যতদিন বঁাচে হালদার-পরিবারের বিষয় এবং সংসারের ব্যবস্থা সেই করিবে । خچه J বনোয়ারি বুঝিলেন, এ পরিবারে কেহ তঁহাকে ছেলে দিয়াও ভরসা পায় না, বিষয় দিয়াও না । তিনি কিছুই পারেন না, সমন্তই নষ্ট করিয়া দেন, এ সম্বন্ধে এ বাড়িতে কাহারও দুই মত নাই। অতএব, তিনি বরাদ্দমত আহার করিয়া কোণের ঘরে নিদ্ৰা দিবেন, তাহার পক্ষে এইরূপ বিধান । তিনি কিরণকে বলিলেন, “আমি নীলকণ্ঠের পেনসন খাইয়া বঁচিব না। এ বাড়ি ছাড়িয়া চলো আমার সঙ্গে কলিকাতায় ।” “ওমা ! সে কী কথা ! এ তো তোমারই বাপের বিষয়, আর হরিদাস তো তোমারই আপনি ছেলের তুল্য । ওকে বিষয় লিখিয়া দেওয়া হইয়াছে বলিয়া তুমি রাগ কর কেন ?” হায় হায়, তাহার স্বামীর হৃদয় কী কঠিন । এই কচি ছেলের উপরেও ঈর্ষা করিতে তাহার। মন ওঠে ? তাহার শ্বশুর যে উইলটি লিখিয়াছে কিরণ মনে মনে তাহার সম্পূর্ণ সমর্থন করে । তাহার নিশ্চয় বিশ্বাস, বনোয়ারির হাতে যদি বিষয় পড়িত। তবে রাজ্যের যত ছোটােলোক, যত যদু মধু, যত কৈবর্ত এবং মুসলমান জেলার দল তাহাকে ঠকাইয়া কিছু আর বাকি রাখিত না এবং হালদার-বংশের এই ভাৰী আশা একদিন অকুলে ভাসিত । শ্বশুরের কুলে বাতি জ্বলিবার দীপটি তো ঘরে আসিয়াছে, এখন তাহার তৈলসঞ্চয় যাহাতে নষ্ট না হয় নীলকণ্ঠই তো তাহার উপযুক্ত প্রহরী। বনোয়ারি দেখিল, নীলকণ্ঠ অন্তঃপুরে আসিয়া ঘরে ঘরে সমস্ত জিনিসপত্রের লিস্ট করিতেছে এবং যেখানে যত সিন্দুক-বাক্স আছে তাহাতে তালাচাবি লগাইতেছে। অবশেষে কিরণের শোবার ঘরে আসিয়া সে বনোয়ারির নিত্যব্যবহার্য সমস্ত দ্রব্য ফর্দভুক্ত করিতে লাগিল। নীলকণ্ঠের অন্তঃপুরে গতিবিধি আছে, সুতরাং কিরণ তাহকে লজ্জা করে না। কিরণ শ্বশুরের শোকে ক্ষণে ক্ষণে অশ্রু মুছিবার অবকাশে বাস্পরুদ্ধ কণ্ঠে বিশেষ করিয়া সমস্ত জিনিস বুঝাইয়া দিতে লাগিল । বনোয়ারি সিংহগর্জনে গর্জিয়া উঠিয়া নীলকণ্ঠকে বলিল, “তুমি এখনি আমার ঘর হইতে বাহির হইয়া যাও ।” নীলকণ্ঠ নম্র হইয়া কহিল, “বড়োবাবু, আমার তো কোনো দোষ নাই। কর্তার উইল-অনুসারে আমাকে তো সমস্ত বুঝিয়া লইতে হইবে । আসবাবপত্র সমস্তই তো হরিদাসের ” কিরণ মনে মনে কহিল, “দেখো একবার, ব্যাপারখানা দেখো । হরিদাস কি আমাদের পর । নিজের ছেলের সামগ্ৰী ভোগ করিতে আবার লজা কিসের । আর, জিনিসপত্র মানুষের সঙ্গে যাইবে না কি । আজ না হয়। কাল ছেলেপূলেরাই তো ভোগ করবে।” এ বাড়ির মেঝে বনোয়ারির পায়ের তলায় কাটার মতো বিধিতে লাগিল, এ বাড়ির দেয়াল তাহার দুই চক্ষুকে যেন দগ্ধ করিল। তাহার বেদনা যে কিসের তাহা বলিবার লোকও এই বৃহৎ পরিবারে কেহ काष्ट्रि | এই মুহুর্তেই বাড়িঘর সমস্ত ফেলিয়া বাহির হইয়া যাইবার জন্য বনোয়ারির মন ব্যাকুল হইয়া উঠিল । কিন্তু, তাহার রাগের জ্বালা যে থামিতে চায় না । সে চলিয়া যাইবে আর নীলকণ্ঠ আরামে একাধিপত্য করবে, এ কল্পনা সে সহ্য করিতে পারিল না। এখনি কোনো একটা গুরুতর অনিষ্ট করিতে না পারিলে তাহার মন শান্ত হইতে পারিতেছে না । সে বলিল, “নীলকণ্ঠ কেমন বিষয় রক্ষা করিতে পারে। আমি তাহা দেখিব ।” বাহিরে তাহার পিতার ঘরে গিয়া দেখিল, সে ঘরে কেহই নাই। সকলেই অন্তঃপুরের তৈজসপত্র ও গহনা প্রভৃতির খবরদারি করিতে গিয়াছে। অত্যন্ত সাবধান লোকেরও সাবধানতায় ক্ৰটি থাকিয়া