পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se \)S\, কিন্তু, এ কী করিতেছি। এ কি একটা গল্প যে উপন্যাস লিখিতে বসিলাম । এমন সুরে আমার লেখা শুরু হইবে এ আমি কি জানিতাম । মনে ছিল, কয় বৎসরের বেদনার যে মেঘ কালো হইয়া জমিয়া উঠিয়াছে, তাহাকে বৈশাখসন্ধ্যার ঝোড়ো বৃষ্টির মতো প্ৰবল বর্ষণে নিঃশেষ করিয়া দিব । কিন্তু, ন, পারিলাম বাংলায় শিশুপাঠ্য বই লিখিতে, কারণ সংস্কৃত মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ আমার পড়া নাই ; আর, না পারিলাম কাব্য রচনা করিতে, কারণ মাতৃভাষা আমার জীবনের মধ্যে এমন পুপিত হইয়া উঠে নাই যাহাতে নিজের অন্তরকে বাহিরে টানিয়া আনিতে পারি । সেইজন্যই দেখিতেছি, আমার ভিতরকার শ্মশানচারী সন্ন্যাসীটা অট্টহাস্যে আপনাকে আপনি পরিহাস করিতে বসিয়াছে । না করিয়া করিবে কী । তাহার-যে অশ্রু শুকাইয়া গেছে। জ্যৈষ্ঠের খররেদ্রই তো জ্যৈষ্ঠেরই অশ্রশান্য রোদিন । আমার সঙ্গে যাহার বিবাহ হইয়াছিল তাহার সত্য নামটা দিব না । কারণ, পৃথিবীর ইতিহাসে তাহার নামটি লইয়া প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিবাদের কোনো আশঙ্কা নাই । যে তাম্রশাসনে তাহার নাম খোদাই করা আছে সেটা আমার হৃদয়পট । কোনোকালে সে পট এবং সে নাম বিলুপ্ত হইবে, এমন কথা আমি মনে করিতে পারি না । কিন্তু, যে অমৃতলোকে তাহা অক্ষয় হইয়া রহিল সেখানে ঐতিহাসিকের আনাগোনা নাই । আমার এ লেখায় তাহার যেমন হউক একটা নাম চাই । আচ্ছা, তাহার নাম দিলাম শিশির । কেননা, শিশিরে কান্নাহাসি একেবারে এক হইয়া আছে, আর শিশিরে ভোরবেলাটুকুর কথা সকালবেলায় আসিয়া ফুরাইয়া যায় । শিশির আমার চেয়ে কেবল দুই বছরের ছোটাে ছিল । অথচ, আমার পিতা যে গৌরীন্দানের পক্ষপাতী ছিলেন না। তাহা নহে । তাহার পিতা ছিলেন উগ্রভাবে সমাজবিদ্রোহী ; দেশের প্রচলিত ধর্মকর্ম কিছুতে তাহার আস্থা ছিল না ; তিনি কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন । আমার পিতা উগ্রভাবে সমাজের অনুগামী ; মানিতে তাহার বাধে এমন জিনিস আমাদের সমাজে, সদরে বা অন্দরে, দেউড়ি বা খিড়কির পথে খুঁজিয়া পাওয়া দায়, কারণ ইনিও কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন । পিতামহ এবং পিতা উভয়েরই মতামত বিদ্রোহের দুই বিভিন্ন মূর্তি | কোনােটাই সয়ল স্বাভাবিক নহে। তবুও বড়ো বয়সের মেয়ের সঙ্গে বাবা যে আমার বিবাহ দিলেন তাহার কারণ, মেয়ের বয়স বড়ো বলিয়াই পণের অঙ্কটাও বড়ো । শিশির আমার শ্বশুরের একমাত্র মেয়ে । বাবার বিশ্বাস ছিল, কন্যার পিতার সমস্ত টাকা ভাবী জামাতার ভবিষ্যতের গর্ভ পূরণ করিয়া তুলিতেছে । * আমার শ্বশুরের বিশেষ কোনো একটা মতের বালাই ছিল না । তিনি পশ্চিমের এক পাহাড়ের কোনো রাজার অধীনে বড়ো কাজ করিতেন । শিশির যখন কোলে তখন তাহার মার মৃত্যু হয় । মেয়ে বৎসর-অন্তে এক-এক বছর করিয়া বড়ো হইতেছে, তাহা আমার শ্বশুরের চোখেই পড়ে নাই । সেখানে তাহার সমাজের লোক এমন কেহই ছিল না যে তাহাকে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিবে । শিশিরের বয়স যথাসময়ে ষোলো হইল ; কিন্তু সেটা স্বভাবের ষোলো, সমাজের ষোলো নহে । কেহ তাহাকে আপনি বয়সের জন্য সতর্ক হইতে পরামর্শ দেয় নাই, সেও আপনি বয়সটার দিকে ফিরিয়াও তাকাইত না । কলেজে তৃতীয় বৎসরে পা দিয়াছি, আমার বয়স উনিশ, এমন সময় আমার বিবাহ হইল। বয়সটা সমাজের মতে বা সমাজসংস্কারকের মতে উপযুক্ত কি না তাহা লইয়া তাহারা দুই পক্ষ লড়াই করিয়া রক্তারক্তি করিয়া মরুক, কিন্তু আমি বলিতেছি, সে বয়সটা পরীক্ষা পাস করিবার পক্ষে যত ভালো হউক, বিবাহের সম্বন্ধ আসিবার পক্ষে কিছুমাত্র কম ভালো নয় । বিবাহের অরুণোদয় হইল একখানি ফোটোগ্রাফের আভাসে । পড়া মুখস্থ করিতেছিলাম। একজন ঠাট্টার সম্পর্কের আত্মীয়া আমার টেবিলের উপরে শিশিরের ছবিখানি রাখিয়া বলিলেন, “এইবার সত্যিকার পড়া পড়ো- একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙিয়া ।” কোনো একজন আনাড়ি কারিগরের তোলা ছবি । মা ছিল না, সুতরাং কেহ তাহার চুল টানিয়া বাধিয়া খোপায় জরি জড়াইয়া, সাহা বা মল্লিক কোম্পানির জবড়াজঙ জ্যাকেট পরাইয়া বরপক্ষের চোখ