পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

se WS হৈম চমকিয়া কহিল, “বাবা বলিয়াছেন ? কখনো না ।” মা কহিলেন, “অবাক করিল। বেহাই আমার সামনে নিজের মুখে বলিলেন, আর মেয়ে বলে “কখনো না” !” এই বলিয়া আর-একবার চোখ টিপিলেন । এবার হৈম ইশারার মানে বুঝিল । স্বর আরো দৃঢ় করিয়া বলিল, “বাবা এমন কথা কখনোই বলিতে १° 5 ।।' মা গলা চড়াইয়া বলিলেন, “তুই আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতে চাস ?” হৈম বলিল, “আমার বাবা তো কখনোই মিথ্যা বলেন না ।” ইহার পরে মা যতই গালি দিতে লাগিলেন কথাটার কালি ততই গড়াইয়া ছড়াইয়া চারি দিকে লেপিয়া গেল । মা রাগ করিয়া বাবার কাছে তাহার বধুর মুঢ়তা এবং ততোধিক একণ্ঠয়েমির কথা বলিয়া দিলেন । বাবা হৈমকে ডাকিয়া বলিলেন, “আইবড় মেয়ের বয়স সতেরো, এটা কি খুব একটা গৌরবের কথা, তাই ঢাক পিটিয়া বেড়াইতে হইবে ? আমাদের এখানে এ-সব চলিবে না, বলিয়া রাখিতেছি ।” হায় রে, তাহার বউমার প্রতি বাবার সেই মধুমাখা পঞ্চম স্বর আজ একেবারে এমন বাজ খাই খাদে নাবিল কেমন করিয়া । হৈম ব্যথিত হইয়া প্রশ্ন করিল, “কেহ যদি বয়স জিজ্ঞাসা করে কী বলিব ।” বাবা বলিলেন, “মিথ্যা বলিবার দরকার নাই, তুমি বলিয়ো “আমি জানি না, আমার শাশুড়ি अन्e' |” কেমন করিয়া মিথ্যা বলিতে না হয় সেই উপদেশ শুনিয়া হৈম এমন ভাবে চুপ করিয়া রহিল যে বাবা বুঝিলেন, তাহার সদুপদেশটা একেবারে বাজে খরচ হইল । হৈমর দুৰ্গতিতে দুঃখ করিব কী, তাহার কাছে আমার মাথা হেঁট হইয়া গেল। সেদিন দেখিলাম, শরৎপ্ৰভাতের আকাশের মতো তাহার চোখের সেই সরল উদার দৃষ্টি একটা কী সংশয়ে স্নান হইয়া গেছে। ভীত হরিণীর মতো সে আমার মুখের দিকে চাহিল। ভাবিল, “আমি ইহাদিগকে চিনি না।” সেদিন একখানা শৌখিন-বাধাই-করা ইংরাজি কবিতার বই তাহার জন্য কিনিয়া আনিয়াছিলাম । বইখানি সে হাতে করিয়া লইল এবং আস্তে আস্তে কোলের উপর রাখিয়া দিল, একবার খুলিয়া দেখিল আমি তাহার হাতখানি তুলিয়া ধরিয়া বলিলাম, “হৈম, আমার উপর রাগ করিয়ো না । আমি তোমার সত্যে কখনো আঘাত করিব না, আমি যে তোমার সত্যের বাধনে বাধা ।” হৈম কিছু না বলিয়া একটুখানি হাসিল । সে হাসি বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন তাহার কোনো কথা বলিবার দরকার নাই । পিতার আর্থিক উন্নতির পর হইতে দেবতার অনুগ্রহকে স্থায়ী করিবার জন্য নূতন উৎসাহে আমাদের বাড়িতে পূজাৰ্চনা চলিতেছে। এ পর্যন্ত সে-সমস্ত ক্রিয়াকর্মে বাড়ির বধূকে ডাক পড়ে নাই ! দুপুর প্রতি একদিন পূজা সাঙ্গাইবার আদেশ হইল, সে বলল, “মা, বলিয়া দাও কী করতে "ן ইহাতে কাহারও মাথায় আকাশ ভাঙিয়া পড়িবার কথা নয়, কারণ সকলেরই জানা ছিল, মাতৃহীন প্রবাসে কন্যা মানুষ । কিন্তু কেবলমাত্ৰ হৈমকে লজ্জিত করাই এই আদেশের হেতু । সকলেই গালে হাত দিয়া বলিল, “ওমা, এ কী কাণ্ড । এ কোন নাস্তিকের ঘরের মেয়ে । এবার এ সংসার হইতে লক্ষ্মী ছাড়িল, আর দেরি নাই ।” এই উপলক্ষে হৈমর বাপের উদ্দেশে যাহা-না-বলিবার তাহা বলা হইল। যখন হইতে কটুকথার হাওয়া দিয়াছে, হৈম একেবারে চুপ করিয়া সমস্ত সহ্য করিয়াছে। একদিনের জন্য কাহারও সামনে সে চোখের জলও ফেলে নাই । আজ তাহার বড়ো বড়ো দুই চোখ ভাসাইয়া দিয়া জল পড়িতে লাগিল । সে উঠিয়া দাড়াইয়া বলিল, “আপনারা জানেন- সে দেশে আমার বাবাকে সকলে ঋষি বলে ?”