পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VOУ br রবীন্দ্র-রচনাবলী ঋষি বলে ! ভারি একটা হাসি পড়িয়া গেল । ইহার পরে তাহার পিতার উল্লেখ করিতে হইলে প্রায়ই বলা হইত, তোমার ঋষিবাবা ! এই মেয়েটির সকলের চেয়ে দরদের জায়গাটি যে কোথায় তাহা আমাদের সংসার বুঝিয়া লইয়াছিল। . বস্তুত, আমার শ্বশুর ব্ৰাহ্মও নন, খৃষ্টানও নন, হয়তো বা নাস্তিকও না হইবেন । দেবাৰ্চনার কথা কোনোদিন তিনি চিন্তাও করেন নাই । মেয়েকে তিনি অনেক পড়াইয়াছেন-শুনাইয়াছেন, কিন্তু কোনোদিনের জন্য দেবতা সম্বন্ধে তিনি তাহাকে কোনো উপদেশ দেন নাই । বনমালীবাবু এ লইয়া র্তাহাকে একবার প্রশ্ন করিয়াছিলেন । তিনি বলিয়াছিলেন, “আমি যাহা বুঝি না। তাহা শিখাইতে গেলে কেবল কপটতা শেখানো হইবে ।” অন্তঃপুরে হৈমর একটি প্রকৃত ভক্ত ছিল, সে আমার ছোটাে বোন নারানী । বউদিদিকে ভালোবাসে বলিয়া তাহাকে অনেক গঞ্জনা সহিতে হইয়াছিল । সংসারযাত্রায় হৈমর সমস্ত অপমানের পালা আমি তাহার কাছেই শুনিতে পাইতাম । একদিনের জন্যও আমি হৈমর কাছে শুনি নাই । এ-সব কথা সংকোচে সে মুখে আনিতে পারতি না । সে সংকোচ নিজের জন্য নহে। হৈম তাহার বাপের কাছ হইতে যত চিঠি পাইত সমস্ত আমাকে পড়িতে দিত । চিঠিগুলি ছোটো কিন্তু রসে ভরা । সেও বাপকে যত চিঠি লিখিত সমস্ত আমাকে দেখাইত । বাপের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধটিকে আমার সঙ্গে ভাগ করিয়া না লইলে তাহার দাম্পত্য যে পূর্ণ হইতে পারিত না । তাহার চিঠিতে শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে কোনো নালিশের ইশারাটুকুও ছিল না। থাকিলে বিপদ ঘটিতে পারিত। নারানীর কাছে শুনিয়াছি, শ্বশুরবাড়ির কথা কী লেখে জানিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার চিঠি খোলা হইত । চিঠির মধ্যে অপরাধের কোনো প্ৰমাণ না পাইয়া উপরওয়ালাদের মন যে শান্ত হইয়াছিল তাহা নহে । বোধ করি তাহাতে তাহারা আশাভঙ্গের দুঃখই পাইয়াছিলেন । বিষম বিরক্ত হইয়া তাহারা বলিতে লাগিলেন, “এত ঘন ঘন চিঠিই বা কিসের জন্য ? বাপাই যেন সব, আমরা কি কেহ নাই ?” এই লইয়া অনেক অপ্ৰিয় কথা চলিতে লাগিল । আমি ক্ষুব্ধ হইয়া হৈমকে বলিলাম, “তোমার বাবার চিঠি আর-কাহাকেও না দিয়া আমাকেই দিয়ে । কলেজে যাইবার সময় আমি পোস্ট করিয়া দিব ।” হৈম বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেন ?” আমি লজায় তাহার উত্তর দিলাম না । বাড়িতে এখন সকলে বলিতে আরম্ভ করিল, “এইবার অপুর মাথা খাওয়া হইল। বি. এ. ডিগ্রি শিকায় তোলা রহিল । ছেলেরই বা দোষ কী ।” সে তো বটেই। দোষ সমস্তই হৈমর । তাহার দোষ যে তাহার বয়স সতেরো ; তাহার দোষ যে আমি তাহাকে ভালোবাসি ; তাহার দোষ যে বিধাতার এই বিধি, তাই আমার হৃদয়ের রন্ধে রন্ধে সমস্ত আকাশ আজ বাশি বাজাইতেছে । বি. এ. ডিগ্রি অকাতরচিত্তে আমি চুলায় দিতে পারিতাম। কিন্তু হৈমর কল্যাণে পণ করিলাম, পাস করিবই এবং ভালো করিয়াই পাস করিব । এ পণ রক্ষা করা আমার সে-অবস্থায় যে সম্ভবপর বোধ হইয়াছিল তাহার দুইটি কারণ ছিল- এক তো হৈমর ভালোবাসার মধ্যে এমন একটি আকাশের বিস্তার ছিল যে, সংকীর্ণ আসক্তির মধ্যে সে মনকে জড়াইয়া রাখিত না, সেই ভালোবাসার চারি দিকে ভারি একটি স্বাস্থ্যকর হাওয়া বহিত । দ্বিতীয়, পরীক্ষার জন্য যে বইগুলি পড়ার প্রয়োজন তাহা হৈমর সঙ্গে একত্রে মিলিয়া পড়া অসম্ভব ছিল না । পরীক্ষা পাসের উদযোগে কোমর বাধিয়া লাগিলাম। একদিন রবিবার মধ্যাহ্নে বাহিরের ঘরে বসিয়া মাটিনের চরিত্রতত্ত্ব বইখানার বিশেষ বিশেষ লাইনের মধ্যপথগুলা ফাড়িয়া ফেলিয়া নীল পেনসিলের লাঙল চালাইতেছিলাম, এমন সময় বাহিরের দিকে হঠাৎ আমার চোেখ পড়িল । আমার ঘরের সমুখে আঙিনার উত্তর দিকে অন্তঃপুরে উঠিবার একটা সিঁড়ি । তাহারই গায়ে গায়ে