পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৩৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ V) SS মাঝে মাঝে গরাদে-দেওয়া এক-একটা জানলা । দেখি তাহারই একটি জানলায় হৈম চুপ করিয়া বসিয়া আমার বুকে ধক করিয়া একটা ধাক্কা দিল ; মনের মধ্যে একটা অনবধানতার আবরণ ছিড়িয়া পড়িয়া গেল। এই নিঃশব্দ গভীর বেদনায় রূপটি আমি এতদিন এমন স্পষ্ট করিয়া দেখি নাই ! কিছু না, আমি কেবল তাহার বসিবার ভঙ্গিটুকু দেখিতে পাইতেছিলাম। কোলের উপরে একটি হাতের উপর আর-একটি হাত স্থির পড়িয়া আছে, মাথাটি দেয়ালের উপরে হেলানো, খোলা চুল বাম কাধের উপর দিয়া বুকের উপর বুলিয়া পড়িয়াছে। আমার বুকের ভিতরটা তুহু করিয়া উঠিল । আমার নিজের জীবনটা এমনি কানায় কানায় ভরিয়াছে যে, আমি কোথাও কোনো শূন্যতা লক্ষ করিতে পারি নাই। আজ হঠাৎ আমার অত্যন্ত নিকটে অতি বৃহৎ একটা নৈরাশ্যের গহবর দেখিতে পাইলাম। কেমন করিয়া কী দিয়া আমি তাহা পূরণ করি । আমাকে তো কিছুই ছাড়িতে হয় নাই। না আত্মীয়, না অভ্যাস, না কিছু। হৈম-যে সমস্ত ফেলিয়া আমার কাছে আসিয়াছে । সেটা কতখানি তাহা আমি ভালো করিয়া ভাবি নাই । আমাদের সংসারে অপমানে কণ্টকশয়নে সে বসিয়া ; সে শয়ন আমিও তাহার সঙ্গে ভাগ করিয়া লইয়াছি । সেই দুঃখে৷ হৈমর সঙ্গে আমার যোগ ছিল, তাহাতে আমাদিগকে পৃথক করে নাই। কিন্তু, এই গিরিনন্দিনী সতেরো বৎসর-কাল অন্তরে বাহিরে কত বড়ো একটা মুক্তির মধ্যে মানুষ হইয়াছে। কী নির্মল সত্যে এবং উদার আলোকে তাহার প্রকৃতি এমন ঋজু শুভ্র ও সবল হইয়া উঠিয়াছে। তাহা হইতে হৈম যে কিরূপ নিরতিশয় ও নিষ্ঠুর রূপে বিচ্ছিন্ন হইয়াছে এতদিন তাহা আমি সম্পূর্ণ অনুভব করিতে পারি নাই, কেননা সেখানে তাহার সঙ্গে আমার সমান আসন ছিল না । হৈম যে অন্তরে অন্তরে মুহুর্তে মুহুর্তে মরিতেছিল। তাহাকে আমি সব দিতে পারি। কিন্তু মুক্তি দিতে পারি না- তাহা আমার নিজের মধ্যে কোথায় ? সেইজন্যই কলিকাতার গলিতে ঐ গরাদের ফাক দিয়া নির্বক আকাশের সঙ্গে তাহার নির্বক মনের কথা হয় ; এবং এক-একদিন রাত্রে হঠাৎ জাগিয়া উঠিয়া দেখি, সে বিছানায় নাই ; হাতের উপর মাথা রাখিয়া আকাশ-ভরা তারার দিকে মুখ তুলিয়া ছাতে শুইয়া আছে । মাটিনো পড়িয়া রহিল । ভাবিতে লাগিলাম, কী করি । শিশুকাল হইতে বাবার কাছে আমার সংকোচের অন্ত ছিল না- কখনো মুখামুখি তাহার কাছে দরবার করিবার সাহস বা অভ্যাস আমার ছিল না । সেদিন থাকিতে পারিলাম না । লজ্জার মাথা খাইয়া তাহাকে বলিয়া বসিলাম, “বউয়ের শরীর ভালো নয়, তাহাকে একবার বাপের কাছে পাঠাইলে হয় ।” বাবা তো একেবারে হতবুদ্ধি। মনে লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, হৈমই এরূপ অভূতপূর্ব স্পর্ধায় আমাকে প্রবর্তিত করিয়াছে । তখনই তিনি উঠিয়া অন্তঃপুরে গিয়া হৈমকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বলি, বউমা, তোমার অসুখটা কিসের ।” হৈম বলিল, “অসুখ তো নাই ।” বাবা ভাবিলেন, এ উত্তরটা তেজ দেখাইবার জন্য । কিন্তু, হৈমর শরীরও যে দিনে দিনে শুকাইয়া যাইতেছিল। তাহা আমরা প্ৰতিদিনের অভ্যাসবশতই বুঝি নাই। একদিন বনমালীবাবু তাহাকে দেখিয়া চমকিয়া উঠিলেন, “আঁ্যা, এ কী ! হৈমী, এ কেমন চেহারা তোর ! অসুখ করে নাই তো ?” হৈম কহিল, “না ।” এই ঘটনার দিনদশেক পরেই, বলা নাই, কহা নাই, হঠাৎ আমার শ্বশুর আসিয়া উপস্থিত ৷ হৈমর শরীরের কথাটা নিশ্চয় বনমালীবাবু তাহাকে লিখিয়াছিলেন । বিবাহের পর বাপের কাছে বিদায় লইবার সময় মেয়ে আপনার অশ্রু চাপিয়া নিয়াছিল । এবার মানা মানিল না । বাপ একটি কথা বলিতে পারিলেন না, জিজ্ঞাসা পর্যন্ত করিলেন না, “কেমন