পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

WSO SR SR রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি এমনি আশ্চর্য হইয়া গেলাম যে, তাহাকে ভালো করিয়া দেখিতেই পাইলাম না । ব্যাপারটা নিতান্তই সাদা অথচ আমার কাছে তাহা এমন করিয়া প্ৰকাশ হইল যে, সেই যে গাভীটি রিকালবেলাকার ধূসর রৌদ্রে লেজ দিয়া পিঠের মাছি তাড়াইতে তাড়াইতে, নববর্ষার রসকোমল ঘাসগুলি বড়ো বড়ো নিশ্বাস ফেলিতে ফেলিতে শান্ত আনন্দে খাইয়া বেড়াইতেছে, তাহার জীবলীলাটি আমার কাছে বড়ো অপরূপ হইয়া দেখা দিল । এ কথা বলিলে লোকে হাসিবে, কিন্তু আমার মন ভক্তিতে ভরিয়া উঠিল । আমি সহজ-আনন্দময় জীবনেশ্বরকে প্ৰণাম করিলাম । বাগানের আমগাছ হইতে পাতা-সমেত একটি কচি আমের ডাল লইয়া সেই গাভীকে খাওয়াইলাম । আমার মনে হইল, আমি দেবতাকে সন্তুষ্ট করিয়া দিলাম । ইহার পরবৎসর যখন সেখানে গিয়াছি তখন মাঘের শেষ । সেবার তখনো শীত ছিল ; সকালের রৌদ্রটি পুবের জানলা দিয়া আমার পিঠে আসিয়া পড়িয়াছিল, তাহাকে নিষেধ করি নাই। দোতলার ঘরে বসিয়া লিখিতেছিলাম, বেহােরা আসিয়া খবর দিল, আনন্দী বোষ্টমী আমার সঙ্গে দেখা করিতে চায় । লোকটা কে জানি না ; অন্যমনস্ক হইয়া বলিলাম, “আচ্ছা, এইখানে নিয়ে আয় ।” বোষ্টমী পায়ের ধূলা লইয়া আমাকে প্ৰণাম করিল। দেখিলাম, সেই আমার পূর্বপরিচিত স্ত্রীলোকটি । সে সুন্দরী কি না সেটা লক্ষ্যগোচর হইবার বয়স তাহার পার হইয়া গেছে। দোহারা, সাধারণ স্ত্রীলোকের চেয়ে লম্বা ; একটি নিয়ত-ভক্তিতে তাহার শরীরটি নম্র, অথচ বলিষ্ঠ নিঃসংকোচ তাহার ভাব | সব চেয়ে চোখে পড়ে তাহার দুই চোেখ । ভিতরকার কী-একটা শক্তিতে তাহার সেই বড়ো বড়ো চোখদুটি যেন কোন দূরের জিনিসকে কাছে করিয়া দেখিতেছে । তাহার সেই দুই চোখ দিয়া আমাকে যেন ঠেলা দিয়া সে বলিল, “এ আবার কী কাণ্ড । আমাকে তোমার এই রাজসিংহাসনের তলায় আনিয়া হাজির করা কেন । তোমাকে গাছের তলায় দেখিতাম, সে যে বেশ ছিল |” বুঝিলাম, গাছতলায় এ আমাকে অনেকদিন লক্ষ্য করিয়াছে কিন্তু আমি ইহাকে দেখি নাই। সন্দির উপক্রম হওয়াতে কয়েকদিন পথে ও বাগানে বেড়ানো বন্ধ করিয়া ছাদের উপরেই সন্ধ্যাকাশের সঙ্গে মোকাবিলা করিয়া থাকি ; তাই কিছুদিন সে আমাকে দেখিতে পায় নাই । একটুক্ষণ থামিয়া সে বলিল, “ গেীর, আমাকে কিছু-একটা উপদেশ দাও।” আমি মুশকিলে পড়িলাম । বলিলাম, “উপদেশ দিতে পারি না, নিতেও পারি না । চোখ মেলিয়া চুপ করিয়া যাহা পাই তাহা লইয়াই আমার কারবার । এই যে তোমাকে দেখিতেছি, আমার দেখাও হইতেছে শোনাও হইতেছে ।” বোষ্টমী ভারি খুশি হইয়া “গীের গীের বলিয়া উঠিল । কহিল, “ভগবানের তো শুধু রসনা নয়, তিনি যে সর্বাঙ্গ দিয়া কথা কন ।” আমি বলিলাম, “চুপ করিলেই সর্বাঙ্গ দিয়া তার সেই সর্বাঙ্গের কথা শোনা যায় । তাই শুনিতেই শহর ছাড়িয়া এখানে আসি ।” যাইবার সময় সে আমার পায়ের ধুলা লইতে গিয়া, দেখিলাম, আমার মোজাতে হাত ঠেকিয়া তাহার বড়ো বাধা বোধ হইল । পরের দিন ভোরে সূর্য উঠিবার পূর্বে আমি ছাদে আসিয়া বসিয়াছি। দক্ষিণে বাগানের ঝাউগাছগুলার মাথার উপর দিয়া একেবারে দিকসীমা পর্যন্ত মাঠ ধুধু করিতেছে। পূর্ব দিকে বাশবনে-ঘেরা গ্রামের পাশে আখের খেতের প্রান্ত দিয়া প্রতিদিন আমার সামনে সূর্য উঠে। গ্রামের রাস্তাটা গাছের ঘন ছায়ার ভিতর হইতে হঠাৎ বাহির হইয়া খোলা মাঠের মাঝখান দিয়া বাকিয়া বহুদূরের গ্রামগুলির কােজ সারিতে চলিয়াছে। সূৰ্য উঠিয়াছে কি না জানি না । একখানি শুভ্ৰ কুয়াশার চাদর বিধবার ঘোমটার মতো গ্রামের