পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5阳é两 V) S \) গাছগুলির উপর টানা রহিয়াছে। দেখিতে পাইলাম, বোষ্টমী সেই ভোরের ঝাপসা আলোর ভিতর দিয়া একটি সচল কুয়াশার মূর্তির মতো করতাল বাজাইয়া হরিনাম গান করিতে করিতে সেই পুব দিকের গ্রামের সমুখ দিয়া চলিয়াছে। তন্দ্ৰাভাঙা চোখের পাতার মতো এক সময়ে কুয়াশাটা উঠিয়া গেল এবং ঐ-সমস্ত মাঠের ও ঘরের নানা কাজকর্মের মাঝখানে শীতের রৌদ্রটি গ্রামের ঠাকুরদাদার মতো আসিয়া বেশ করিয়া জমিয়া বসিল । আমি তখন সম্পাদকের পেয়াদা বিদায় করিবার জন্য লিখিবার টেবিলে আসিয়া বসিয়াছি । এমন সময় সিঁড়িতে পায়ের শব্দের সঙ্গে একটা গানের সুর শোনা গেল। বোষ্টমী গুনগুনা করিতে করিতে আসিয়া আমাকে প্ৰণাম করিয়া কিছু দূরে মাটিতে বসিল । আমি লেখা হইতে মুখ তুলিলাম । সে বলিল, “কাল আমি তোমার প্রসাদ পাইয়াছি।” আমি বলিলাম, “সে কী কথা ।” সে কহিল, “কাল সন্ধ্যার সময় কখন তোমার খাওয়া হয়। আমি সেই আশায় দরজার বাহিরে বসিয়া ছিলাম । খাওয়া হইলে চাকর যখন পাত্ৰ লইয়া বাহিরে আসিল তাহাতে কী ছিল জানি না। কিন্তু আমি খাইয়াছি।” আমি আশ্চর্য হইলাম । আমার বিলাত যাওয়ার কথা সকলেই জানে । সেখানে কী খাইয়াছি না-খাইয়াছি তাহা অনুমান করা কঠিন নহে, কিন্তু গোবর খাই নাই। দীর্ঘকাল মাছমাংসে আমার রুচি নাই বটে কিন্তু আমার পাচকটির জাতিকুলের কথাটা প্রকাশ্য সভায় আলোচনা না করাই সংগত । আমার মুখে বিস্ময়ের লক্ষণ দেখিয়া বোষ্টমী বলিল, “যদি তোমার প্রসাদ খাইতেই না পারিব, তবে তোমার কাছে আসিবার তো কোনো দরকার ছিল না ।” আমি বলিলাম, “ লোকে জানিলে তোমার উপর তো তাদের ভক্তি থাকিবে না ।” সে বলিল, “আমি তো সকলকেই বলিয়া বেড়াইয়াছি । শুনিয়া উহারা ভাবিল, আমার এইরকমই দশা ||” বোষ্টমী যে সংসারে ছিল উহার কাছে তাহার খবর বিশেষ কিছু পাইলাম না। কেবল এইটুকু শুনিয়াছি, তাহার মায়ের অবস্থা বেশ ভালো এবং এখনো তিনি বাচিয়া আছেন । মেয়েকে যে বহু লোক ভক্তি করিয়া থাকে সে খবর তিনি জানেন । তাহার ইচ্ছা, মেয়ে তার কাছে গিয়া থাকে, কিন্তু আনন্দীর মন তাহাতে সায় দেয় না । উত্তরে শুনিলাম, তাহার ভক্তদের একজন তাহাকে সামান্য কিছু জমি দিয়াছে। তাহারই ফসলে সেও খায়, পাচজনে খায়, কিছুতে সে আর শেষ হয় না । বলিয়া একটু হাসিয়া কহিল, “আমার তো দুই ভুল মুকু ছাডিয়া আসিয়াছ আবার পরের কাছে মাগিয়া সংগ্ৰহ কৰিতেছ। ইহার কী দরকার বলো তো ?” শহরে থাকিতে এ প্রশ্ন উঠিলে সহজে ছাড়িতাম না । ভিক্ষাজীবিতায় সমাজের কত অনিষ্ট তাহা বুঝাইতাম । কিন্তু, এ জায়গায় আসিলে আমার পুঁথিপড়া বিদ্যার সমস্ত বঁাজ একেবারে মরিয়া যায় । বােষ্টমীর কাছে কোনো তর্কই আমার মুখ দিয়া বাহির হইতে চাহিল না ; আমি চুপু করিয়া রহিলাম। আমার উত্তরের অপেক্ষা না রাখিয়া সে আপনিই বলিয়া উঠিল, “না, না, এই আমার ভালো । আমার মাগিয়া-খাওয়া অন্নই অমৃত ।” তাহার কথার ভাবখানা আমি বুঝিলাম। প্রতিদিনই যিনি নিজে অন্ন জোগাইয়া দেন ভিক্ষার অন্নে তাহাকেই মনে পড়ে । আর, ঘরে মনে হয়, আমারই অন্ন আমি নিজের শক্তিতে ভোগ করিতেছি । ইচ্ছা ছিল তাহার স্বামীর ঘরের কথা জিজ্ঞাসা করি, কিন্তু সে নিজে বলিল না, আমিও প্রশ্ন করিলাম। ୩ | এখানকার যে-পাড়ায় উচ্চবর্ণের ভদ্রলোকে থাকে সে-পাড়ার প্রতি বোষ্টমীর শ্রদ্ধা নাই । বলে,