পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৪৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

○ミb রবীন্দ্র-রচনাবলী ভিজা-কাপড়ে তার সঙ্গে দেখা হওয়াতে লজ্জায় একটু পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছি, এমন সময়ে তিনি আমার নাম ধরিয়া ডাকিলেন । আমি জড়োসড়ো হইয়া মাথা নিচু করিয়া দাড়াইলাম । তিনি আমার মুখের পরে দৃষ্টি রাখিয়া বলিলেন, “তোমার দেহখানি সুন্দর।” ডালে ডালে রাজ্যের পাখি ডাকিতেছিল, পথের ধারে ধারে ঝোপে-ঝোপে ভাটি ফুল ফুটিয়াছে, আমের ডালে বােল ধরিতেছে। মনে হইল, সমস্ত আকাশ-পাতাল পাগল হইয়া আলুথালু হইয়া উঠিয়াছে। কেমন করিয়া বাড়ি গেলাম কিছু জ্ঞান নাই । একেবারে সেই ভিজা কাপড়েই ঠাকুরঘরে ঢুকিলাম, চোখে যেন ঠাকুরকে দেখিতে পাইলাম না- সেই ঘাটের পথের ছায়ার উপরকার আলোর চুমকিগুলি আমার চােখের উপর কেবলই নাচিতে লাগিল । সেদিন গুরু আহার করিতে আসিলেন ; জিজ্ঞাসা করিলেন, “আন্দী নাই কেন ।” আমার স্বামী আমাকে খুজিয়া বেড়াইলেন, কোথাও দেখিতে পাইলেন না ! ওগো, আমার সে পৃথিবী আর নাই, আমি সে সূর্যের আলো আর খুঁজিয়া পাইলাম না ! ঠাকুরঘরে আমার ঠাকুরকে ডাকি, সে আমার দিকে মুখ ফিরাইয়া থাকে { দিন কোথায় কেমন করিয়া কাটিল ঠিক জানি না । রাত্রে স্বামীর সঙ্গে দেখা হইবে । তখন যে সমস্ত নীরব এবং অন্ধকার । তখনি আমার স্বামীর মন যেন তারার মতো ফুটিয়া উঠে । সেই আঁধারে এক-একদিন তাহার মুখে একটা-আধটা কথা শুনিয়া হঠাৎ বুঝিতে পারি, এই সাদা মানুষটি যাহা বোঝেন তাহা কতই সহজে বুঝিতে পারেন । সংসারের কােজ সারিয়া আসিতে আমার দেরি হয় । তিনি আমার জন্য বিছানার বাহিরে অপেক্ষা করেন । প্রায়ই তখন আমাদের গুরুর কথা কিছু-না-কিছু হয় । অনেক রাত করিলাম । তখন তিন প্রহর হইবে, ঘরে আসিয়া দেখি, আমার স্বামী তখনো খাটে শোন নাই, নীচে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন । আমি অতি সাবধানে শব্দ না করিয়া তাহার পায়ের তলায় শুইয়া পড়িলাম। ঘুমের ঘোরে একবার তিনি পা ছুড়িলেন, আমার বুকের উপর আসিয়া লাগিল । সেইটেই আমি তাহার শেষদান বলিয়া গ্ৰহণ করিয়াছি । পরদিন ভোরে যখন তার ঘুম ভাঙিল আমি তখন উঠিয়া বসিয়া আছি । জানলার বাহিরে কঁঠালগাছটার মাথার উপর দিয়া আঁধারের একধারে অল্প একটু রঙ ধরিয়াছে ; তখনো কাক ডাকে N আমি স্বামীর পায়ের কাছে মাথা লুটাইয়া প্ৰণাম করিলাম। তিনি তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিলেন এবং আমার মুখের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন । আমি বলিলাম, “আর আমি সংসার করিব না ।” স্বামী বোধ করি ভাবিলেন, তিনি স্বপ্ন দেখিতেছেন- কোনো কথাই বলিতে পারিলেন না । আমি বলিলাম, “আমার মাথার দিব্য, তুমি অন্য স্ত্রী বিবাহ করো ! আমি বিদায় লইলাম।” স্বামী কহিলেন, “তুমি এ কী বলিতেছ। তোমাকে সংসার ছাড়িতে কে বলিল ।” আমি বলিলাম, “গুরুঠাকুর ।” স্বামী হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন, “গুরুঠাকুর ! এমন কথা তিনি কখন বলিলেন ।” আমি বলিলাম, “আজ সকালে যখন স্নান করিয়া ফিরিতেছিলাম তাহার সঙ্গে দেখা হইয়াছিল । তখনি বলিলেন ।” স্বামীর কণ্ঠ কঁপিয়া গেল । জিজ্ঞাসা করিলেন, “এমন আদেশ কেন করিলেন ।” আমি বলিলাম, “জানি না । তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়ো, পারেন তো তিনিই বুঝাইয়া দিবেন।” স্বামী বলিলেন, “সংসারে থাকিয়াও তো সংসার ত্যাগ করা যায়, আমি সেই কথা গুরুকে বুঝাইয়া বলিব ।” আমি বলিলাম, “হয়তো গুরু বুঝিতে পারেন, কিন্তু আমার মন বুঝিবে না । আমার সংসার করা আজ হইতে ঘুচিল ।”