পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

V\98 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে বললুম, “বিন্দু, তুই ভয় করিস নে- শুনেছি, তোর বর ভালো ।” বিন্দু বললে, “বর যদি ভালো হয়, আমার কী আছে যে আমাকে তার পছন্দ হবে।” বরপক্ষেরা বিন্দুকে তো দেখতে আসবার নামও করলে না । বড়দিদি তাতে বড়ো নিশ্চিন্ত হলেন । কিন্তু, দিনরাত্রে বিন্দুর কান্না আর থামতে চায় না । সে তার কী কষ্ট, সে আমি জানি । বিন্দুর জন্যে আমি সংসারে অনেক লড়াই করেছি। কিন্তু, ওর বিবাহ বন্ধ হােক, এ কথা বলবার সাহস আমার হল না । কিসের জোরেই বা বলব । আমি যদি মারা যাই তো ওর কী দশা হবে । একে তো মেয়ে, তাতে কালো মেয়ে- কার ঘরে চলল, ওর কী দশা হবে, সে কথা না ভাবাই ভালো । ভাবতে গেলে প্ৰাণ কেঁপে ওঠে । বিন্দু বললে, “দিদি, বিয়ের আর পাচদিন আছে, এর মধ্যে আমার মরণ হবে না কি ৷” পারত তা হলে আমি আরাম বোধ করাতুম | বিবাহের আগের দিন বিন্দু তার দিদিকে গিয়ে বললে, “দিদি, আমি তোমাদের গোয়ালঘরে পড়ে থাকিব, আমাকে যা বলবে তাই করব, তোমার পায়ে পড়ি আমাকে এমন করে ফেলে দিয়ে না ।” কিছুকাল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দিদির চোখ দিয়ে জল পড়ছিল, সেদিনও পড়ল । কিন্তু, শুধু হৃদয় তো নয়, শাস্ত্রও আছে । তিনি বললেন, “জনিস তো, বিন্দি, পতিই হচ্ছে স্ত্রীলোকের গতি মুক্তি সব । কপালে যদি দুঃখ থাকে তো কেউ খণ্ডাতে পারবে না।” আসল কথা হচ্ছে, কোনো দিকে কোনো রাস্তাই নেই- বিন্দুকে বিবাহ করতেই হবে, তার পরে যা হয় তা হোক । আমি চেয়েছিলুম, বিবাহটা যাতে আমাদের বাড়িতেই হয় । কিন্তু, তোমরা বলে বসলে, বরের বাড়িতেই হওয়া চাই- সেটা তাদের কৌলিক প্রথা । আমি বুঝলুম, বিন্দুর বিবাহের জন্য যদি তোমাদের খরচ করতে হয়, তবে সেটা তোমাদের গৃহদেবতার কিছুতেই সইবে না । কাজেই চুপ করে যেতে হল। কিন্তু, একটি কথা তোমরা কেউ জােন না । দিদিকে জানাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু জানাই নি, কেননা তা হলে তিনি ভয়েই মরে যেতেন- আমার কিছু কিছু গয়না দিয়ে আমি লুকিয়ে বিন্দুকে সাজিয়ে দিয়েছিলুম ! বোধ করি দিদির চোখে সেটা পড়ে থাকবে, কিন্তু সেটা তিনি দেখেও দেখেন নি । দোহাই ধর্মের, সেজন্য তোমরা তাকে ক্ষমা কোরো । যাবার আগে বিন্দু আমাকে জড়িয়ে ধরে বললে, “দিদি, আমাকে তোমরা তা হলে নিতান্তই ত্যাগ করলে ?” আমি বললুম, “না বিন্দি, তোর যেমন দশাই হােক-না কেন, আমি তোকে শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করব कां ।” তিন দিন গেল । তোমাদের তালুকের প্রজা খাবার জন্যে তোমাকে যে ভেড়া দিয়েছিল, তাকে তোমার জঠরাগ্নি থেকে বাচিয়ে আমি আমাদের একতলায় কয়লা-রাখবার ঘরের এক পাশে বাস করতে দিয়েছিলুম। সকালে উঠেই আমি নিজে তাকে দানা খাইয়ে আসতুম ; তোমার চাকরদের প্রতি দু-একদিন নির্ভর করে দেখেছি, তাকে খাওয়ানোর চেয়ে তাকে খাওয়ার প্রতিই তাদের বেশি ঝোক । সেদিন সকালে সেই ঘরে ঢুকে দেখি, বিন্দু এক কোণে জড়সড় হয়ে বসে আছে। আমাকে দেখেই আমার পা জড়িয়ে ধরে লুটিয়ে পড়ে নিঃশব্দে কঁদিতে লাগল । বিন্দুর স্বামী পাগল । “मठिा दब्लछिन, ििन ?” “এত বড়ো মিথ্যা কথা তোমার কাছে বলতে পারি, দিদি ? তিনি পাগল । শ্বশুরের এই বিবাহে মত ছিল না- কিন্তু তিনি আমার শাশুড়িকে যমের মতো ভয় করেন। তিনি বিবাহের পূর্বেই কাশী চলে গেছেন । শাশুড়ি জেদ করে তার ছেলের বিয়ে দিয়েছেন ।” আমি সেই রাশ-করা কয়লার উপর বসে পড়লুম। মেয়েমানুষকে মেয়েমানুষ দয়া করে না। বলে,