পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

9V)(? ও তো মেয়েমানুষ বৈ তো নয়। ছেলে হােক-না পাগল, সে তো পুরুষ বটে ।” বিন্দুর স্বামীকে হঠাৎ পাগল বলে বোঝা যায় না, কিন্তু এক-একদিন সে এমন উন্মাদ হয়ে ওঠে যে, তাকে ঘরে তালাবন্ধ করে রাখতে হয় । বিবাহের রাত্রে সে ভালো ছিল কিন্তু রাত-জাগা প্রভৃতি উৎপাতে দ্বিতীয় দিন থেকে তার মাথা একেবারে খারাপ হয়ে উঠল । বিন্দু দুপুরবেলায় পিতলের থালায় ভাত খেতে বসেছিল, হঠাৎ তার স্বামী থালাসুদ্ধ ভাত টেনে উঠোনে ফেলে দিলে । হঠাৎ কেমন তার মনে হয়েছে, বিন্দু স্বয়ং রানী রাসমণি ; বেহারাটা নিশ্চয় সোনার থালা চুরি করে রানীকে তার নিজের থালায় ভাত খেতে দিয়েছে। এই তার রাগ । বিন্দু তো ভয়ে মরে গেল । তৃতীয় রাত্রে শাশুড়ি তাকে যখন স্বামীর ঘরে শুতে বললে, বিন্দুর প্রাণ শুকিয়ে গেল । শাশুড়ি তার প্রচণ্ড, রাগলে জ্ঞান থাকে না । সেও পাগল, কিন্তু পুরো নয় বলেই আরো ভয়ানক । বিন্দুকে ঘরে ঢুকতে হল । স্বামী সে রাত্রে ঠাণ্ডা ছিল । কিন্তু, ভয়ে বিন্দুর শরীর যেন কাঠ হয়ে গেল । স্বামী যখন ঘুমিয়েছে অনেক রাত্রে সে অনেক কৌশলে পালিয়ে চলে এসেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ লেখবার দরকার নেই । ঘূণায় রাগে আমার সকল শরীর জ্বলতে লাগল। আমি বললুম, “এমন ফকির বিয়ে বিয়েই নয় । বিন্দু, তুই যেমন ছিলি তেমনি আমার কাছে থাক, দেখি তোকে কে নিয়ে যেতে পারে।” তোমরা বললে, “বিন্দু মিথ্যা কথা বলছে।” আমি বললুম, “ও কখনো মিথ্যা বলে নি ।” আমি বললুম, “আমি নিশ্চয় জানি ।” তোমরা ভয় দেখালে, “বিন্দুর শ্বশুরবাড়ির লোকে পুলিস-কেস করলে মুশকিলে পড়তে হবে ।” আমি বললুম, “ফাকি দিয়ে পাগল বরের সঙ্গে ওর বিয়ে দিয়েছে। এ কথা কি আদালত শুনবে না।” তোমরা বললে, “তবে কি এই নিয়ে আদালত করতে হবে নাকি । কেন, আমাদের দায় কিসের ।” আমি বললুম, “আমি নিজের গয়না বেচে যা করতে পারি করব ।” তোমরা বললে, “উকিলবাড়ি ছুটবে নাকি ৷” এ কথার জবাব নেই। কপালে করাঘাত করতে পারি, তার বেশি আর কী করব । ওদিকে বিন্দুর শ্বশুরবাড়ি থেকে ওর ভাসুর এসে বাইরে বিষম গোল বাধিয়েছে। সে বলছে, সে থানায় খবর দেবে । আমার যে কী জোর আছে জানি নে- কিন্তু কসাইয়ের হাত থেকে যে গোরু প্ৰাণভয়ে পালিয়ে এসে আমার আশ্রয় নিয়েছে তাকে পুলিসের তাড়ায় আবার সেই কসাইয়ের হাতে ফিরিয়ে দিতেই হবে, এ কথা কোনোমতেই আমার মন মানতে পারল না। আমি স্পর্ধা করে বললুম, “তা দিক থানায় খবর !” এই বলে মনে করলুম, বিন্দুকে এইবেলা আমার শোবার ঘরে এনে তাকে নিয়ে ঘরে তালাবন্ধ করে বসে থাকি । খোজ করে দেখি, বিন্দু নেই। তোমাদের সঙ্গে আমার বাদপ্রতিবাদ যখন চলছিল তখন বিন্দু আপনি বাইরে গিয়ে তার ভাসুরের কাছে ধরা দিয়েছে। বুঝেছে, এ বাড়িতে যদি সে থাকে। তবে আমাকে সে বিষম বিপদে ফেলবে । মাঝখানে পালিয়ে এসে বিন্দু আপনি দুঃখ আরো বাড়ালে । তার শাশুড়ির তর্ক এই যে, তার ছেলে তো ওকে খেয়ে ফেলছিল না । মন্দ স্বামীর দৃষ্টান্ত সংসারে দুর্লভ নয়, তাদের সঙ্গে তুলনা করলে তার ছেলে যে সোনার চাদ । আমার বড়ো জা বললেন, “ওর পোড়া কপাল, তা নিয়ে দুঃখ করে কী করব । তা পাগল হােক, ছাগল হােক, স্বামী তো বটে ।” কুষ্ঠরোগীকে কোলে করে তার স্ত্রী বেশ্যার বাড়িতে নিজে পৌঁছে দিয়েছে সতীসাধবীর সেই দৃষ্টান্ত তোমাদের মনে জাগছিল ; জগতের মধ্যে অধমতম কাপুরুষতার এই গল্পটা প্রচার করে আসতে তোমাদের পুরুষের মনে আজ পর্যন্ত একটুও সংকোচবোধ হয় নি, সেইজন্যই মানবজন্ম নিয়েও বিন্দুর