পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৬

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VVOr রবীন্দ্র-রচনাবলী কিন্তু মৃত্যুর বঁাশি বাজতে লািগল— কোথায় রে রাজমিস্ত্রির গড়া দেয়াল, কোথায় রে তোমাদের ঘোরো আইন দিয়ে গড়া কাটার বেড়া ; কোন দুঃখে কোন অপমানে মানুষকে বন্দী করে রেখে দিতে পারে !! ঐ তো মৃত্যুর হাতে জীবনের জয়পতাকা উড়ছে ! ওরে মেজেবিউ, ভয় নেই তোর ! তোর মেজোবউয়ের খোলস ছিন্ন হতে এক নিমেষও লাগে না । তোমাদের গলিকে আর আমি ভয় করি নে। আমার সমুখে আজ নীল সমুদ্র, আমার মাথার উপরে আষাঢ়ের মেঘপুঞ্জ । তোমাদের অভ্যাসের অন্ধকারে আমাকে ঢেকে রেখে দিয়েছিলে । ক্ষণকালের জন্য বিন্দু এসে সেই আবরণের ছিদ্র দিয়ে আমাকে দেখে নিয়েছিল । সেই মেয়েটাই তার আপনার মৃত্যু দিয়ে আমার আবরণখানা আগাগোড়া ছিন্ন করে দিয়ে গেল । আজ বাইরে এসে দেখি, আমার গৌরব রাখবার আর জায়গা নেই। আমার এই অনাদৃত রূপ যার চোখে ভালো লেগেছে, সেই সুন্দর সমস্ত আকাশ দিয়ে আমাকে চেয়ে দেখছেন । এইবার মরেছে মেজেবিউ । তুমি ভাবছ। আমি মরতে যাচ্ছি- ভয় নেই, অমন পুরোনো ঠাট্টা তোমাদের সঙ্গে আমি করব না । মীরাবাঈও তো আমারই মতো মেয়েমানুষ ছিল- তার শিকলও তো কম ভারী ছিল না, তাকে তো বঁচবার জন্যে মরতে হয় নি। মীরাবাঈ তার গানে বলেছিল, “ছাড়ক বাপ, ছাড়ক মা, ছাড়ক যে যেখানে আছে, মীরা কিন্তু লেগেই রইল, প্ৰভু- তাতে তার যা হবার তা হােক ৷” এই লেগে থাকাই QV6| GKQ5 QIK5 | আমিও বঁচিব । আমি বঁাচলুম। তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন মৃণাল । Kiel Y VO SR Y শ্রাবণ মাসটা আজ যেন এক রাত্রে একেবারে দেউলে হইয়া গেছে । সমস্ত আকাশে কোথাও একটা ছেড়া মেঘের টুকরাও নাই। আশ্চর্য এই যে, আমার সকালটা আজ এমন করিয়া কাটিতেছে। আমার বাগানের মেহেদি-বেড়ার প্রান্তে শিরীষগাছের পাতাগুলা ঝলমল করিয়া উঠিতেছে, আমি তাহা তাকাইয়া দেখিতেছি । সর্বনাশের যে মােঝ-দরিয়ায় আসিয়া পৌঁছিয়ছি। এটা যখন দূরে ছিল তখন ইহার কথা কল্পনা করিয়া কত শীতের রাত্রে সর্বাঙ্গে ঘাম দিয়াছে, কত গ্ৰীষ্মের দিনে হাত-পায়ের তোলো ঠাণ্ডা হিম হইয়া গেছে । কিন্তু আজ সমস্ত ভয়ভাবনা হইতে এমনি ছুটি পাইয়াছি যে, ঐ যে আতাগাছের ডালে একটা গিরগিটি স্থির হইয়া শিকার লক্ষ্য করিতেছে, সেটার দিকেও আমার চোখ রহিয়াছে । সর্বস্ব খোয়াইয়া পথে দাড়াইব, এটা তত কঠিন না-কিন্তু আমাদের বংশে যে সততার খ্যাতি আজ তিন-পুরুষ চলিয়া আসিয়াছে সেটা আমারই জীবনের উপর আছড়ে খাইয়া চুরমার হইতে চলিল, সেই লজাতেই আমার দিনরাত্রি স্বস্তি ছিল না ; এমন-কি, আত্মহত্যার কথাও অনেকবার ভাবিয়াছি । কিন্তু, আজ যখন আর পর্দা রহিল না, খাতাপত্রের গুহাগহবর হইতে অখ্যাতিগুলো কালো ক্রিমির মতো কিলবিল করিয়া বাহির হইয়া আদালত হইতে খবরের কাগজময় ছড়াইয়া পড়িল, তখন আমার একটা মন্ত বোঝা নামিয়া গেল। পিতৃপুরুষের সুনামটাকে টানিয়া বেড়াইবার দায় হইতে রক্ষা পাইলাম । সবাই জানিল, আমি জুয়াচোর। বাচা গেল ।