পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৫৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

NO)8 O রবীন্দ্র-রচনাবলী যখন তার ছোটাে বোনের কান্না থামাইবার জন্য কত কী বাজে কথা বলিত- তাকে ভুলইয়া দুধ খাওয়াইবার সময় যেখানে পাখি নাই সেখানেও পাখি আছে বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে উড়ো খবর দিবার চেষ্টা করিত, আমি তাকে ভয়ংকর গভীর হইয়া সাবধান করিয়া দিয়াছি ; বলিয়াছি, “উহাকে যে মিথ্যা বলিতেছ, পরমেশ্বর সমস্ত শুনিতেছেন, এখনই তার কাছে তোমার মাপ চাওয়া উচিত ।” এমনি করিয়া আমি তাকে যত শাসন করিয়াছি, সে আমার শাসন মানিয়াছে । সে নিজেকে যতই অপরাধী মনে করিত আমি ততই খুশি হইতাম । কড়া শাসনে মানুষের ভালো করিবার সুযোগ পাইলে, নিজে যে অনেক শাসনে ভালো হইয়াছি সেটার একটা দাম ফিরিয়া পাওয়া যায়। অনুও আমাকে নিজের এবং পৃথিবীর অধিকাংশের তুলনায় অদ্ভুত ভালো বলিয়া জানিত । ক্ৰমে বয়স বাড়িয়াছে, ইস্কুল হইতে কলেজে গিয়াছি। অখিলবাবুর স্ত্রীর মনে মনে ইচ্ছা ছিল, আমার মতো ভালো ছেলের সঙ্গে অনুর বিবাহ দেন। আমারও মনে এটা ছিল, কোনো কন্যার পিতার চোখ এড়াইবার মতো ছেলে আমি নই। কিন্তু একদিন শুনিলাম, বি. এল. পাস করা একটি টাটকা মুনসেফের সঙ্গে অনুর সম্বন্ধ পাকা হইয়াছে। আমরা গরিব— আমি তো জানিতাম, সেটাতেই আমাদের দাম বাড়িয়াছে। কিন্তু কন্যার পিতার হিসাবের প্রণালী স্বতন্ত্র । বিসর্জনের প্রতিমা ডুবিল। একেবারে জীবনের কোন আড়ালে সে পড়িয়া গেল। শিশুকাল হইতে যে আমার সকলের চেয়ে পরিচিত, সে একদিনের মধ্যেই এই হাজার লক্ষ অপরিচিত মানুয্যের সমুদ্রের মধ্যে তলাইয়া গেল । সেদিন মনে যে কী বাজিল তাহা মনই জানে । কিন্তু বিসর্জনের পরেও কি চিনিয়াছিলাম, সে আমার দেবীর প্রতিমা ? তা নয় । অভিমান সেদিন ঘা খাইয়া আরো ঢেউ খেলাইয়া উঠিয়াছিল । অনুকে তো চিরকাল ছোটাে করিয়াই দেখিয়া আসিয়াছি ; সেদিন আমার যোগ্যতার তুলনায় তাকে আরো ছোটাে করিয়া দেখিলাম। আমার শ্রেষ্ঠতার যে পূজা হইল না, সেদিন এইটেই সংসারের সকলের চেয়ে বড়ো অকল্যাণ বলিয়া জানিয়াছি। যাক, এটা বোঝা গেল সংসারে শুধু সৎ হইয়া কোনো লাভ নাই। পণ করিলাম, এমন টাকা করিব যে একদিন অখিলবাবুকে বলিতে হইবে, বড়ো ঠিকান ঠকিয়াছি।” খুব কষিয়া কাজের লোক হইবার জোগাড় করিলাম । কাজের লোক হইবার সব চেয়ে বড়ো সরঞ্জাম নিজের পরে অগাধ বিশ্বাস, সে পক্ষে আমার কোনোদিন কোনো কমতি ছিল না । এ জিনিসটা ছোয়াচে । যে নিজেকে বিশ্বাস করে, অধিকাংশ লোকেই তাকে বিশ্বাস করে । কেজো বুদ্ধিটা যে আমার স্বাভাবিক এবং অসাধারণ সেটা সকলেই মানিয়া লইতে লাগিল । কেজো সাহিত্যের বই এবং কাগজে আমার শেলফ এবং টেবিল ভরিয়া উঠিল । বাড়ি-মেরামত, ইলেকট্রিক আলো ও পাখার কৌশল, কোন জিনিসের কত দর, বাজারদার ওঠাপড়ার গৃঢ়তত্ত্ব, একসচেঞ্জের রহস্য, প্ল্যান, এস্টিমেট প্রভৃতি বিদ্যায় আসার জমাইবার মতো ওস্তাদি আমি একরকম মারিয়া লইয়াছিলাম । কিন্তু অহরহ কাজের কথা বলি অথচ কিছুতে কোনো কাজেই নামি না, এমনভাবে অনেকদিন কাটিল । আমার ভক্তরা যখনই আমাকে কোনো-একটা স্বদেশী কোম্পানিতে যোগ দিবার প্রস্তাব করিত আমি বুঝাইয়া দিতাম, যতগুলা কারবার চলিতেছে, কোনোটার কাজের ধারা বিশুদ্ধ নহে, সকলেরই মধ্যে গলদ বিস্তর- তা ছাড়া, সততা বাচাইয়া চলিতে হইলে ওদের কাছে ঘোষিবার জো নাই। সততার লাগামে একটু-আধটু ঢ়িল না দিলে ব্যবসা চলে না, এমন কথা আমার কোনো বন্ধু বলাতে তার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হইয়া গেছে । মৃত্যুকাল পর্যন্ত সর্বাঙ্গসুন্দর প্ল্যান এস্টিমেন্টু এবং প্রস্পেক্টস লিখিয়া আমার যশ অক্ষুন্ন রাখিতে পারিতাম। কিন্তু বিধির বিপাকে প্ল্যান করা ছাড়িয়া কাজ করায় লাগিলাম। এক তো পিতার মৃত্যু হওয়াতে আমার ঘাড়েই সংসারের দায় চাপিল ; তার পরে আর-এক উপসর্গ আসিয়া জুটিল, সে কথাও বলিতেছি ।