পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৭৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

SGS কলেজে যতগুলা পরীক্ষা পাস করিবার সব আমি চুকাইয়াছি । ছেলেবেলায় আমার সুন্দর চেহারা লইয়া পণ্ডিতমশায় আমাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সহিত তুলনা করিয়া বিদ্রুপ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন । ইহাতে তখন বড়ো লজ্জা পাইতাম ; কিন্তু বয়স হইয়া এ কথা ভাবিয়াছি, যদি জন্মান্তর থাকে। তবে আমার মুখে সুরূপ এবং পণ্ডিতমশায়দের মুখে বিদ্রুপ আবার যেন এমনি করিয়াই প্ৰকাশ পায় । আমার পিতা এককালে গরিব ছিলেন । ওকালতি করিয়া তিনি প্রচুর টাকা রোজগার করিয়াছেন, ভোগ করিবার সময় নিমেষমাত্রও পান নাই। মৃত্যুতে তিনি যে হাফ ছাড়িলেন, সেই তার প্রথম অবকাশ । আমার তখন বয়স অল্প । মার হাতেই আমি মানুষ । মা গরিবের ঘরের মেয়ে ; তাই, আমরা যে ধনী এ কথা তিনিও ভোলেন না, আমাকেও ভুলিতে দেন না । শিশুকালে আমি কোলে কোলেই মানুষ- বোধ করি, সেইজন্য শেষ পর্যন্ত আমার পুরাপুরি বয়সই হইল না । আজও আমাকে দেখিলে মনে হইবে, আমি অন্নপূর্ণার কোলে গজাননের ছোটাে ভাইটি । আমার আসল অভিবাবক আমার মামা । তিনি আমার চেয়ে বড়োজোর বছর ছয়েক বড়ো । কিন্তু ফন্ধুর বালির মতো তিনি আমাদের সমস্ত সংসারটাকে নিজের অন্তরের মধ্যে শুষিয়া লইয়াছেন । তাহাকে না খুঁড়িয়া এখানকার এক গণ্ডুষও রস পাইবার জো নাই। এই কারণে কোনো কিছুর জন্যই আমাকে কোনো ভাবনা ভাবিতেই হয় না । কন্যার পিতা মাত্রেই স্বীকার করিবেন, আমি সৎপাত্র । তামাকটুকু পর্যন্ত খাই না । ভালোমানুষ হওয়ার কোনো ঝঞ্ঝাট নাই, তাই আমি নিতান্ত ভালোমানুষ । মাতার আদেশ মানিয়া চলিবার ক্ষমতা আমার আছে— বস্তুত না-মানিবার ক্ষমতা আমার নাই। অন্তঃপুরের শাসনে চলিবার মতো করিয়াই আমি প্ৰস্তুত হইয়াছি, যদি কোনো কন্যা স্বয়ম্বর হন তবে এই সুলক্ষণটি স্মরণ রাখিবেন । অনেক বড়ো ঘর হইতে আমার সম্বন্ধ আসিয়াছিল। কিন্তু মামা, যিনি পৃথিবীতে আমার ভাগ্যদেবতার প্রধান এজেন্ট, বিবাহ সম্বন্ধে তার একটা বিশেষ মত ছিল । ধনীর কন্যা তার পছন্দ নয় । আমাদের ঘরে যে মেয়ে আসিবে সে মাথা হেঁট করিয়া আসিবে, এই তিনি চান । অথচ টাকার প্রতি আসক্তি তার অস্থিমজ্জায় জড়িত । তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা নাই। অথচ যে টাকা দিতে কসুর করিবে না । যাহাকে শোষণ করা চলিবে অথচ বাড়িতে আসিলে গুড়গুড়ির পরিবর্তে বাধা হুকায় তামাক দিলে যাহার নালিশ খাটিবে না । আমার বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ করে । সে ছুটিতে কলিকাতায় আসিয়া আমার মন উতলা করিয়া দিল । সে বলিল, “ওহে, মেয়ে যদি বল একটি খাসা মেয়ে আছে।” কিছুদিন পূর্বেই এম. এ. পাস করিয়াছি। সামনে যতদূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে ছুটি ধুধু করিতেছে ; পরীক্ষা নাই, উমেদারি নাই, চাকরি নাই ; নিজের বিষয় দেখিবার চিন্তাও নাই, শিক্ষাও নাই, ইচ্ছাও নাই- থাকিবার মধ্যে ভিতরে আছেন মা এবং বাহিরে আছেন মামা । এই অবকাশের মরুভূমির মধ্যে আমার হৃদয় তখন বিশ্বব্যাপী নারীরূপের মরীচিকা দেখিতেছিলআকাশে তাহার দৃষ্টি, বাতাসে তাহার নিশ্বাস, তরুমাির্মরে তাহার গোপন কথা । এমন সময় হরিশ আসিয়া বলিল, “মেয়ে যদি বল, তবে- ।” আমার শরীর মন বসন্তবাতাসে বকুলবনের নবপল্লবরাশির মতো কঁাপিতে কঁাপিতে আলোছায়া ধুনিতে লাগিল। হরিশ মানুষটা ছিল রসিক, রস দিয়া বৰ্ণনা করিবার শক্তি তাহার ছিল, আর আমার মন ছিল তুষার্ত । আমি হরিশকে বলিলাম, “একবার মামার কাছে কথাটা পাড়িয়া দেখো ।” হরিশ আসর জমাইতে অদ্বিতীয় । তাই সর্বত্রই তাহার খাতির । মামাও তাহাকে পাইলে ছাড়িতে চান না । কথাটা তার বৈঠকে উঠিল । মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের খবরটাই তাহার কাছে গুরুতর । বাপের অবস্থা তিনি যেমনটি চান তেমনি। এককালে ইহাদের বংশে লক্ষ্মীর মঙ্গলঘট ভরা ছিল। এখন তাহা শূন্য বলিলেই হয়, অথচ তলায় সামান্য কিছু বাকি আছে। দেশে ৰংশমর্যাদা রাখিয়া চলা সহজ