পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VV8 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী এদিকে আমি শুনিলাম, সে মেয়ের নাকি ভালো পাত্ৰ জুটিয়াছিল। কিন্তু সে পণ করিয়াছে, বিবাহ করিবে না। শুনিয়া আমার মন পুলকের আবেশে ভরিয়া গেল। আমি কল্পনায় দেখিতে লাগিলাম, সে, ভালো করিয়া খায় না ; সন্ধ্যা হইয়া আসে, সে চুল বাধিতে ভুলিয়া যায়। তার বাপ তার মুখের পানে চান আর ভাবেন, “আমার মেয়ে দিনে দিনে এমন হইয়া যাইতেছে কেন।” হঠাৎ কোনোদিন তার ঘরে। আসিয়া দেখেন, মেয়ের দুই চক্ষু জলে ভরা। জিজ্ঞাসা করেন, “মা, তোর কী হইয়াছে বলে আমাকে ৷” মেয়ে তাড়াতাড়ি চোখের জল মুছিয়া বলে, “কই, কিছুই তো হয় নি, বাবা।” বাপের এক মেয়ে যেবড়ো আদরের মেয়ে। যখন অনাবৃষ্টির দিনের ফুলের কুঁড়িটির মতো মেয়ে একেবারে বিমর্ষ হইয়া পড়িয়াছে তখন বাপের প্রাণে আর সহিল না । তখন অভিমান ভাসাইয়া দিয়া তিনি ছুটিয়া আসিলেন আমাদের দ্বারে । তার পরে ? তার পরে মনের মধ্যে সেই যে কালো রঙের ধারাটা বহিতেছে সে যেন কালো সাপের মতো রােপ ধরিয়া ফোস করিয়া উঠিল।”সে বলিল, “বেশ তো, আর-একবার বিবাহের আসর সাজানো হােক, আলো জ্বালুক, দেশ-বিদেশের লোকের নিমন্ত্রণ হােক, তার পরে তুমি বরের টোপর পায়ে দলিয়া দলবল লইয়া সভা ছাড়িয়া চলিয়া এসো ।” কিন্তু, যে ধারাটি চোখের জলের মতো শুভ্ৰ সে রাজহংসের রূপ ধরিয়া বলিল, যেমন করিয়া আমি একদিন দময়ন্তীর পুষ্পবনে গিয়াছিলাম তেমনি করিয়া আমাকে একবার উড়িয়া যাইতে দাও- আমি বিরাহিণীর কানে কানে একবার সুখের খবরটা দিয়া আসি গে।” তার পরে ? তার পরে দুঃখের রাত পোহাইল, নববর্ষার জল পড়িল, স্নান ফুলটি মুখ তুলিল- এবারে সেই দেয়ালটার বাহিরে রহিল সমস্ত পৃথিবীর আর-সবাই, আর ভিতরে প্ৰবেশ করিল একটিমাত্র মানুষ। তার পরে ? তার পরে আমার কথাটি ফুরালো । 8 কিন্তু, কথা এমন করিয়া ফুরাইল না। যেখানে আসিয়া তাহা অফুরান হইয়াছে সেখানকার বিবরণ একটুখানি বলিয়া আমার এ লেখা শেষ করিয়া দিই। মাকে লইয়া তীর্থে চলিয়াছিলাম। আমার উপরেই ভার ছিল । কারণ, মামা এবারেও হাবড়ার পুল পার হন নাই। রেলগাড়িতে ঘুমাইতেছিলাম। ঝাকানি খাইতে খাইতে মাথার মধ্যে নানাপ্রকার এলোমেলো স্বপ্নের ঝুমঝুমি বাজিতেছিল। হঠাৎ একটা কোন স্টেশনে জাগিয়া উঠিলাম। আলোতে অন্ধকারে মেশা সেও এক স্বপ্ন ; কেবল আকাশের তারাগুলি চিরপরিচিত— আর সবই অজানা অস্পষ্ট ; স্টেশনের দীপ-কয়টা খাড়া হইয়া দাড়াইয়া আলো ধরিয়া এই পৃথিবীটা যে কত অচেনা, এবং যাহা চারি দিকে তাহা যে কতই বহুদূরে, তাহাই দেখাইয়া দিতেছে। গাড়ির মধ্যে মা ঘুমাইতেছেন ; আলোর নীচে সবুজ পর্দা টানা ; তোরঙ্গ বাক্স জিনিসপত্র সমস্তই কে কার ঘাড়ে এলোমেলো হইয়া রহিয়াছে, তাহারা যেন স্বল্পলোকের উলটাপালট আসবাব, সবুজ প্রদোষের মিটমিট আলোতে থাকা এবং না-থাকার মাঝখানে কেমন-একরকম হইয়া পড়িয়া আছে । এমন সময়ে সেই অদ্ভুত পৃথিবীর অদ্ভুত রাত্রে কে বলিয়া উঠিল, “শিগগির চলে আয়, এই গাড়িতে v ” মনে হইল, যেন গান শুনিলাম। বাঙালি মেয়ের গলায় বাংলা কথা যে কী মধুর তাহা এমনি করিয়া অসময়ে অজায়গায় আচমকা শুনিলে তবে সম্পূর্ণ বুঝিতে পারা যায়। কিন্তু, এই গলাটিকে কেবলমাত্র মেয়ের গলা বলিয়া একটা শ্রেণীভুক্ত করিয়া দেওয়া চলে না, এ কেবল একটি মানুষের গলা ; শুনিলেই মন বলিয়া ওঠে, “এমন তো আর শুনি নাই ।” চিরকাল গলার স্বর আমার কাছে বড়ো সত্য। রূপ জিনিসটি বড়ো কম নয়। কিন্তু মানুষের মধ্যে যাহা অন্তরতম এবং অনির্বচনীয়, আমার মনে হয়, কণ্ঠস্বর যেন তারই চেহারা আমি তাড়াতাড়ি গাড়ির জানলা খুলিয়া বাহিরে মুখ বাড়াইয়া দিলাম ; কিছুই দেখিলাম না। প্ল্যাটফর্মের অন্ধকারে দাড়াইয়া গার্ড তাহার একচক্ষু লণ্ঠন নাড়িয়া দিল, গাড়ি চলিল ; আমি জানলার কাছে বসিয়া রহিলাম ।