পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

5国@瓦 WVA খাইতে শুরু করিল, আর আমি লজ্জায় জানলার বাহিরে মুখ বাড়াইয়া প্রকৃতির শোভা দেখিতে লাগিলাম । কানপুরে গাড়ি আসিয়া থামিল । মেয়েটি জিনিসপত্র বঁাধিয়া প্ৰস্তুত— স্টেশনে একটি হিন্দুস্থানি চাকর ছুটিয়া আসিয়া ইহাদিগকে নামাইবার উদ্যোগ করিতে লাগিল । মা তখন আর থাকিতে পারিলেন না । জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার নাম কী, মা ।” মেয়েটি বলিল, “আমার নাম কল্যাণী ।” শুনিয়া মা এবং আমি দুইজনেই চমকিয়া উঠিলাম । “ তোমার বাবা-” “তিনি এখানকার ডাক্তার, তার নাম শম্ভুনাথ সেন ।” তার পরেই সবাই নামিয়া গেল । উপসংহার মামার নিষেধ অমান্য করিয়া, মাতৃ-আজ্ঞা ঠেলিয়া, তার পরে আমি কানপুরে আসিয়াছি। কল্যাণীর বাপ এবং কল্যাণীর সঙ্গে দেখা হইয়াছে। হাত জোড় করিয়াছি, মাথা হেঁট করিয়াছি ; শাদ্ভুনাথবাবুর হৃদয় গলিয়াছে । কল্যাণী বলে, “আমি বিবাহ করিব না ।” আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কেন ।” সে বলিল, “মাতৃ-আজ্ঞা ।” কী সর্বনাশ ! এ পক্ষেও মাতুল আছে নাকি । তার পরে বুঝিলাম, মাতৃভূমি আছে। সেই বিবাহ-ভাঙার পর হইতে কল্যাণী মেয়েদের শিক্ষার ব্ৰত গ্ৰহণ করিয়াছে । কিন্তু, আমি আশা ছাড়িতে পারিলাম না । সেই সুরটি যে আমার হৃদয়ের মধ্যে আজও বাজিতেছে- সে যেন কোন ওপারের বাঁশি- আমার সংসারের বাহির হইতে আসিল— সমস্ত সংসারের বাহিরে ডাক দিল । আর, সেই যে রাত্রির অন্ধকারের মধ্যে, আমার কানে আসিয়াছিল “জায়গা আছে, সে যে আমার চিরজীবনের গানের ধুয়া হইয়া রহিল। তখন আমার বয়স ছিল তেইশ, এখন হইয়াছে সাতাশ । এখনো আশা ছাড়ি নাই, কিন্তু মাতুলকে ছাড়িয়াছি। নিতান্ত এক ছেলে বলিয মা আমাকে ছাড়িতে পারেন নাই । তোমরা মনে করিতেছি, আমি বিবাহের আশা করি ? না, কোনোকালেই না । আমার মনে আছে, কেবল সেই একরাত্রির অজানা কণ্ঠের মধুর সুরের আশা- জায়গা আছে। নিশ্চয়ই আছে। নইলে দাড়াব কোথায় ? তাই বৎসরের পর বৎসর যায়— আমি এইখানেই আছি। দেখা হয়, সেই কণ্ঠ শুনি, যখন সুবিধা পাই কিছু তার কাজ করিয়া দিই— আর মন বলে, এই তো জায়গা পাইয়াছি। ওগো অপরিচিতা, তোমার পরিচয়ের শেষ হইল না, শেষ হইবে না ; কিন্তু ভাগ্য আমার ভালো, এই তো আমি জায়গা পাইয়াছি । কার্তিক ১৩২১