পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গল্পগুচ্ছ \OVS জন্য তাকে প্ৰস্তুত হইতে হইবে । অর্থাৎ, তার সশ্রম কারাদণ্ডের মেয়াদ আরো একটা বছর বাড়িয়া গেল । অভিমানের মাথায় বরদা একদিন খুব ঘটা করিয়া ভাত খাইল না । তাহাতে ফল হইল। এই, সন্ধ্যাবেলাকার খাবারটা তাকে আরো বেশি করিয়া খাইতে হইল । মাখনকে সে বাঘের মতো ভয় করিত, তবু মরিয়া হইয়া তাকে গিয়া বলিল, “এখানে থাকলে আমার পড়াশুনো হবে না।” মাখন জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় গেলে সেই অসম্ভব ব্যাপার সম্ভব হতে পারবে ?” সে বলিল, “বিলাতে ।” মাখন তাকে সংক্ষেপে বুঝাইবার চেষ্টা করিলেন, এ সম্বন্ধে তার যে গােলটুকু আছে সে ভূগােলে নয়, সে মগজে । স্বপক্ষের প্রমাণস্বরূপে বরদা বলিল, তারই একজন সতীর্থ এনট্রেন্স স্কুলের তৃতীয় শ্রেণীর শেষ বেঞ্চিটা হইতে একেবারে এক লাফে বিলাতের একটা বড়ো একজামিন মারিয়া আনিয়াছে। মাখন বলিলেন, বরদাকে বিলাতে পাঠাইতে তার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু তার আগে তার বি. এ. পাস করা চাই । এও তো বড়ো মুশকিল ! বি. এ.পাস না করিয়াও বরদা জন্মিয়াছে, বি. এ.পাস না করিলেও সে মরিবে, অথচ জন্মমৃত্যুর মাঝখানটাতে কোথাকার এই বি. এ. পাস বিন্ধ্যপর্বতের মতো খাড়া হইয়া মুনি করিতেছেন কী । তিনিও কি জটা মুড়াইয়া বি. এ. পাসে লাগিয়াছেন । খুব একটা বড়ো দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বরদা বলিল, “বার বার তিনবার ; এইবার কিন্তু শেষ।” আর-একবার পেন্সিলের দাগ-দেওয়া কী-বইগুলো তাকের উপর হইতে পাড়িয়া লইয়া বরদা কোমর বঁাধিতে প্ৰবৃত্ত হইতেছে, এমন সময় একটা আঘাত পাইল, সেটা আর তার সহিল না । স্কুলে যাইবার সময় গাড়ির খোজ করিতে গিয়া সে খবর পাইল যে, স্কুলে যাইবার গাড়ি-ঘোড়াটা মাখন বেচিয়া ফেলিয়াছেন । তিনি বলেন, “দুই বছর লোকসান গেল, কত আর এই খরচ টানি !’ স্কুলে হাঁটিয়া যাওয়া বরদার পক্ষে কিছুই শক্ত নয়, কিন্তু লোকের কাছে এই অপমানের সে কী কৈফিয়ত দিবে। অবশেষে অনেক চিন্তার পর একদিন ভোরবেলায় তার মাথায় আসিল, এ সংসারে মৃত্যু ছাড়া আর-একটা পথ খোলা আছে যেটা বি.এ. পাসের অধীন নয়, এবং যেটাতে দারা সুত ধন জন সম্পূর্ণ অনাবশ্যক । সে আর কিছু নয়, সন্ন্যাসী হওয়া । এই চিন্তাটার উপর কিছুদিন ধরিয়া গোপনে সে বিস্তর সিগারেটের ধোয়া লাগাইল, তার পর একদিন দেখা গেল, স্কুলঘরের মেঝের উপর তার কী-বইয়ের ছেড়া টুকরোগুলো পরীক্ষাদুর্গের ভগ্নাবশেষের মতো ছড়ানো পড়িয়া আছে- পরীক্ষাথীর দেখা নাই । টেবিলের উপর এক টুকরা কাগজ ভাঙা কাচের গেলাস দিয়া চাপা, তাহাতে লেখা “আমি সন্ন্যাসী- আমার আর গাড়ির দরকার হইবে না । শ্ৰীযুক্ত বরদানন্দস্বামী ।” মাখনবাবু কিছুদিন কোনো খোজই করিলেন না । তিনি ভাবিলেন, বরদাকে নিজের গরজেই ফিরিতে হইবে, খাচার দরজা খোলা রাখা ছাড়া আর-কোনো আয়োজনের দরকার নাই। দরজা খোলাই রহিল, কেবল সেই কী-বইগুলার ছেড়া টুকরা সাফ হইয়া গেছে- আর-সমস্তই ঠিক আছে। ঘরের কোণে সেই জলের কুঁজার উপরে কানা-ভাঙা গেলাসটা উপুড় করা, তেলের-দাগে-মলিন চৌকিটার আসনের জায়গায় ছারপোকার উৎপাত ও জীৰ্ণতার ক্রটি মোচনের জন্য একটা পুরাতন অ্যাটুলাসের মলাট পাতা ; এক ধারে একটা শূন্য প্যাকবাক্সের উপর একটা টিনের তেরঙ্গে বরদার নাম আঁকা ; দেয়ালের গায়ে তাকের উপর একটা মলাট-ছেড়া ইংরেজি-বাংলা ডিক্সনারি, হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভারতবর্ষের ইতিহাসের কতকগুলা পাতা, এবং মলাটে রানী ভিক্টোরিয়ার মুখ-আঁকা অনেকগুলো এক্সেসাইজ বই। এই খাতা ঝাড়িয়া দেখিলে ইহার অধিকাংশ হইতে অগডেন কোম্পানির সিগারেট-বাক্স-বাহিনী বিলাতি নটীদের মূর্তি ঝরিয়া পড়িবে। সন্ন্যাস-আশ্রয়ের সময় পথের সান্তনার জন্য এগুলো যে বরদা সঙ্গে লয় নাই, তাহা হইতে বুঝা যাইবে, তার মন প্রকৃতিস্থ ছিল না ।