পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৮৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ና፲፫®Bጂ e) Ş বিশ্বাস পাড়ার লোকের মনে বদ্ধমূল হইতে লাগিল। স্কুলের পণ্ডিতমশায় স্বয়ং বলিলেন, এইজন্যই তো। তিনি বরদাকে গৌতম মুনি নাম দিয়াছিলেন, তখন হইতেই উহার বুদ্ধি বৈরাগ্যে একেবারে নিরেট হইয়াছিল। পিসি প্রত্যহই অন্তত একবার করিয়া তার দাদার জেদী মেজাজের পরে দোষারোপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, “বারদার এত লেখাপড়ার দরকারই বা কী ছিল । টাকার তো অভাব নাই । যাই বল, বাপু, তার শরীরে কিন্তু দোষ ছিল না । আহা, সোনার টুকরো ছেলে ?” তার স্বামী যে পবিত্রতার আদর্শ ছিল এবং সংসারসুদ্ধ সকলেই তার প্রতি অন্যায় করিয়াছে, সকল দুঃখের মধ্যে এই সাত্মনায়, এই গৌরবে ষোড়শীর মন ভরিয়া উঠিতে লাগিল । এদিকে বাপের ব্যথিত হৃদয়ের সমস্ত স্নেহ দ্বিগুণ করিয়া ষোড়শীর উপর আসিয়া পড়িল । বউমা যাতে সুখে থাকে, মাখনের এই একমাত্র ভাবনা । তার বড়ো ইচ্ছা, ষোড়শী তাকে এমন কিছু ফরমাশ করে যেটা দুর্লভ— অনেকটা কষ্ট করিয়া, লোকসান করিয়া তিনি তাকে একটু খুশি করিতে পারিলে যেন বঁাচেন-তিনি এমন করিয়া ত্যাগ স্বীকার করিতে চান যেটা তার পক্ষে প্ৰায়শ্চিত্তের মতো হইতে পারে । ܔ ষোড়শী পনেরো বছরে পড়িল । ঘরের মধ্যে একলা বসিয়া যখন-তখন তার চোখ জলে ভরিয়া আসে । চিরপরিচিত সংসারটা তাকে চারি দিকে যেন আঁটিয়া ধরে, তার প্রাণ হাঁপাইয়া ওঠে । তার ঘরের প্রত্যেক জিনিসটা, তার বারান্দার প্রত্যেক রেলিঙটা, আলিসার উপর যে-কয়টা ফুলের গাছের টাব চিরকাল ধরিয়া খাড়া দাড়াইয়া আছে, তারা সকলেই যেন অস্তরে অস্তরে তাকে বিরক্ত করিতে থাকিত । পদে পদে ঘরের খাটটা, আলনাটা, আলমারিটা- তার জীবনের শূন্যতাকে বিস্তারিত করিয়া ব্যাখ্যা করে ; সমস্ত জিনিসপত্রের উপর তার রাগ হইতে থাকে । সংসারে তার একমাত্র আরামের জায়গা ছিল ঐ জানালার কাছটা । যে-বিশ্বটা তার বাহিরে সেইটেই ছিল তার সব চেয়ে আপন । কেননা, তার 'ঘর হৈল বাহির, বাহির হৈল ঘর” । একদিন যখন বেলা দশটা- অন্তঃপুরে যখন বাটি, বারকোষ, ধামা, চুপড়ি, শিলনোড়া ও পানের বাক্সের ভিড় জমাইয়া ঘরকন্নার বেগ প্রবল হইয়া উঠিয়াছে- এমন সময় সংসারের সমস্ত ব্যস্ততা হইতে স্বতন্ত্র হইয়া জানালার কাছে ষোড়শী আপনার উদাস মনকে শূন্য আকাশে দিকে দিকে রওনা করিয়া দিতেছিল । হঠাৎ ‘জয় বিশ্বেশ্বর বলিয়া হঁক দিয়া এক সন্ন্যাসী তাহদের গেটের কাছে আশথতলা হইতে বাহির হইয়া আসিল । ষোড়শীর সমস্ত দেহতত্ত্ব মীড়টানা বীণার তারের মতো চরম ব্যাকুলতায় বাজিয়া উঠিল । সে ছুটিয়া আসিয়া পিসিকে বলিল, “পিসিমা, ঐ সন্ন্যাসীঠাকুরের ভোগের আয়োজন করো ।” এই শুরু হইল । সন্ন্যাসীর সেবা ষোড়শীর জীবনের লক্ষ্য হইয়া উঠিল । এতদিন পরে শ্বশুরের কাছে বধূর আবদারের পথ খুলিয়াছে। মাখন উৎসাহ দেখাইয়া বলিলেন, বাড়িতে বেশ ভালোরকম একটা অতিথিশালা খোলা চাই । মাখনবাবুর কিছুকাল হইতে আয় কমিতেছিল ; কিন্তু তিনি বারো টাকা সুদে ধার করিয়া সৎকর্মে লাগিয়া গেলেন । সন্ন্যাসীও যথেষ্ট জুটিতে লাগিল । তাদের মধ্যে অধিকাংশ যে খাটি নয়, মাখনের সে বিষয়ে সন্দেহ ছিল না । কিন্তু বিউমার কাছে তার আভাস দিবার জো কী ! বিশেষত জটাধারীরা যখন আহার-আরামের অপরিহার্য ত্রুটি লইয়া গালি দেয়, অভিশাপ দিতে ওঠে, তখন এক-একদিন ইচ্ছা! হইত, তাদের ঘাড়ে ধরিয়া বিদায় করিতে। কিন্তু ষোড়শীর মুখ চাহিয়া তাহদের পায়ে ধরিতে হইত। এই ছিল তার কঠোর প্রায়শ্চিত্ত । সন্ন্যাসী আসিলেই প্ৰথমে অন্তঃপুরে একবার তার তলব পাড়িত । পিসি তাকে লইয়া বসিতেন, ষোড়শী দরজার আড়ালে দাড়াইয়া দেখিত এই সাবধানতার কারণ ছিল এই, পাছে সন্ন্যাসী তাকে