পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯১

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ናigq}Vጂ w®ዓ © সমস্ত জীবের নাড়ীতে নাড়ীতে বোঝাপড়া হইয়া গেছে ; তারই ছোটো বড়ো হাজার হাজার দৃত জীব-হৃদয়ের খাসমহলে আনাগোনার গোপন পথটা জানে- ষোড়শী তো কৃচ্ছসাধনের কাটা গাড়িয়া আজও সে-পথ বন্ধ করিতে পারিল না । কাজেই গেরুয়া রঙকে আরো ঘন করিয়া গুলিতে হইবে । ষোড়শী পণ্ডিতমশায়কে ধরিয়া পড়িল, “আমাকে যোগাসনের প্রণালী বলিয়া দিন ।” পণ্ডিত বলিলেন, “মা, তোমার তো এ-সকল পন্থায় প্রয়োজন নাই । সিদ্ধি তো পাকা আমলকীর মতো। আপনি তোমার হাতে আসিয়া পৌঁছিয়াছে।” তার পুণ্যপ্রভাব লইয়া চারিদিকে লোকে বিস্ময় প্রকাশ করিয়া থাকে, ইহাতে ষোড়শীর মনে একটা স্তবের নেশা জমিয়া গেছে। এমন একদিন ছিল, বাড়ির ঝি চাকর পর্যন্ত তাকে কৃপাপাত্রী বলিয়া মনে করিয়াছে। তাই আজ যখন তাকে পুণ্যবতী বলিয়া সকলে ধন্য-ধন্য করিতে লাগিল, তখন তার বহুদিনের গৌরবের তৃষ্ণা মিটিবার সুযোগ হইল। সিদ্ধি যে সে পাইয়াছে, এ কথা অস্বীকার করিতে তার মুখে বাধে- তাই পণ্ডিতমশায়ের কাছে সে চুপ করিয়া রহিল। মাখনের কাছে ষোড়শী আসিয়া বলিল, “বাবা, আমি কার কাছে প্ৰাণায়াম অভ্যাস করিতে শিখি বলো তো ।” মাখন বলিলেন, “সেটা না শিখিলেও তো বিশেষ অসুবিধা দেখি না । তুমি যত দূরে গেছ, সেইখানেই তোমার নাগাল কজন লোকে পায় ।” তা হউক, প্ৰাণায়াম অভ্যাস করিতেই হইবে । এমনি দুৰ্দৈব যে, মানুষও জুটিয়া গেল । মাখনের বিশ্বাস ছিল, আধুনিক কালের অধিকাংশ বাঙালিই মোটামুটি তারই মতো- অর্থাৎ খায়-দায় ঘুমায়ু, এবং পরের কুৎসাঘটিত ব্যাপার ছাড়া জগতে আর কোনো অসম্ভবকে বিশ্বাস করে না । কিন্তু, প্রয়োজনের তাগিদে সন্ধান করিতে গিয়া দেখিল, বাংলাদেশে এমন মানুষও আছে যে ব্যক্তি খুলনা জেলায় ভৈরব নদের ধারে খাটি নৈমিষারণ্য আবিষ্কার করিয়াছে । এই আবিষ্কারটা যে সত্য তার প্রধান প্ৰমাণ, ইহা কৃষ্ণপ্রতিপদের ভোরবেলায় স্বপ্নে প্রকাশ পাইয়াছে। স্বয়ং সরস্বতী ফাস করিয়া দিয়াছেন । তিনি যদি নিজবেশে আসিয়া আবির্ভূত হইতেন তাহা হইলেও বরঞ্চ সন্দেহের কারণ থাকিত— কিন্তু তিনি তার আশ্চর্য দেবীলীলায় হাড়িচাচা পাখি হইয়া দেখা দিলেন । পাখির লেজে তিনটি মাত্র পালক ছিল, একটি সাদা, একটি সবুজ, মাঝেরটি পাটকিলে । এই পালক তিনটি যে, সত্ত্ব, রজ, তম ; ঋক, যজুঃ, সাম ; সৃষ্টি, স্থিতি, প্ৰলয় ; আজ, কাল, পাণ্ড প্রভৃতি যে তিন সংখ্যার ভেল্কি লইয়া এই জগৎ তাহারই নিদর্শন তাহাতে সন্দেহ ছিল না । তার পর হইতে এই নৈমিষারণ্যে যোগী তৈরি হইতেছে । দুইজন এম. এসসি. ক্লাসের ছেলে কলেজ ছাড়িয়া এখানে যোগ অভ্যাস করেন ; একজন সাবিজজ র্তার সমস্ত পেন্সেন এই নৈমিষারণ্য-ফন্ডে উৎসর্গ করিয়াছেন, এবং তঁর পিতৃমাতৃহীন ভাগনেটিকে এখানকার যোগী ব্ৰহ্মচারীদের সেবার জন্য নিযুক্ত করিয়া দিয়া মনে আশ্চর্য শান্তি পাইয়াছেন । এই নৈমিষারণ্য হইতে ষোড়শীর জন্য যোগ-অভ্যাসের শিক্ষক পাওয়া গেল। সুতরাং মাখনকে নৈমিষারণ্য-কমিটির গৃহী সভ্য হইতে হইল । গৃহী সভ্যোর কর্তব্য নিজের আয়ের ষষ্ঠ অংশ সন্ন্যাসী সভ্যদের ভরণপোষণের জন্য দান করা । গৃহী সভ্যদের শ্রদ্ধার পরিমাণ-অনুসারে এই ষষ্ঠ অংশ অনেক সময় থামোমিটারের পারার মতো সত্য অঙ্কটার উপরে নীচে, ওঠানামা করে । অংশ কষিবার সময় মাখনেরও ঠিকে ভুল হইতে লাগিল। সেই ভুলটার গতি নীচের অঙ্কের দিকে । কিন্তু, এই ভুলচুকে নৈমিষারণ্যের যে ক্ষতি হইতেছিল। ষোড়শী তাহা পূরণ করিয়া দিল। ষোড়শীর গহনা আর বড়ো কিছু বাকি রহিল না, এবং তার মাসহারার টাকা প্রতি মাসে সেই অন্তহিঁত গহনাগুলোর অনুসরণ করিল। বাড়ির ডাক্তার অনাদি আসিয়া মাখনকে কহিলেন, “দাদা, করছি কী । মেয়েটা যে মারা যাবে।” মাখন উদবিগ্ন মুখে বলিলেন, “তই তো, কী করি।” ষোড়শীর কাছে তার আর সাহস নাই। এক সময়ে অত্যন্ত মৃদুস্বরে তাকে আসিয়া বলিলেন, “মা, এত অনিয়মে কি তোমার শরীর টিকবে ।”