পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৩৯৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\9Գ N9 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী চিরকাল প্ৰদক্ষিণ করতে থাকবে । তাদের মানস-রথযাত্রার গাড়িখানা বহু কষ্টে মিল বেস্থাম পেরিয়ে কালাইল-রাস্কিনে এসে কান্ত হয়ে পড়েছে । মাস্টারমশায়ের বুলির বেড়ার বাইরে তারা সাহস করে হাওয়া খেতে বেরোয় না । কিন্তু, আমরা যে-দেশের সাহিত্যকে খোঁটার মতো করে মনটাকে বেঁধে রেখে জাওর কাটাচ্ছি। সে-দেশে সাহিতাটা তো স্থাণু নয়- সেটা সেখানকার প্রাণের সঙ্গে সঙ্গে চলছে। সেই প্ৰাণটা আমার না থাকতে পারে, কিন্তু সেই চলাটা আমি অনুসরণ করতে চেষ্টা করেছি। আমি নিজের চেষ্টায় ফরাসি, জার্মান, ইটালিয়ান শিখে নিলুম ; অল্পদিন হল রাশিয়ান শিখতে শুরু করেছিলুম। আধুনিকতার যে একসপ্রেস গাড়িটা ঘণ্টায় ষাট মাইলের চেয়ে বেগে ছুটে চলেছে, আমি তারই টিকিট কিনেছি। তাই আমি হাকসলি-ডারুয়িনে এসেও ঠেকে যাই নি, টেনিসনকেও বিচার করতে ডরাই নে, এমন-কি, ইবসেন-মেটারলিঙ্কের নামের নীেকা ধরে আমাদের মাসিক সাহিত্যে সস্তা খ্যাতির বাধা কারবার চালাতে আমার সংকোচ বোধ হয় | আমাকেও কোনোদিন একদল মানুষ সন্ধান করে চিনে নেবে, এ আমার আশার অতীত ছিল আমি দেখছি, বাংলাদেশে এমন ছেলেও দু-চারটে মেলে যারা কলেজও ছাড়ে না। অথচ কলেজের বাইরে সরস্বতীর যে বীণা বাজে তার ডাকেও উতলা হয়ে ওঠে । তারাই ক্ৰমে ক্ৰমে দুটি-একটি করে আমার ঘরে এসে জুটতে লাগল । এই আমার এক দ্বিতীয় নেশা ধরল- বকুনি { ভদ্রভাষায় তাকে আলোচনা বলা যেতে পারে । দেশের চারি দিকে সাময়িক ও অসাময়িক সাহিত্যে যে-সমস্ত কথাবার্তা শুনি তা এক দিকে এত কাচা, অন্য দিকে এত পুরানো যে মাঝে মাঝে তার হাফ-ধরানো ভাপসা গুমোটটাকে উদার চিন্তার খোলী হাওয়ায় কাটিয়ে দিতে ইচ্ছা করে । অথচ লিখতে কুঁড়েমি আসে । তাই মন দিয়ে কথা শোনে এমন লোকের নাগাল পেলে বেঁচে যাই । দল আমার বাড়তে লাগল। আমি থাকতুম আমাদের গলির দ্বিতীয় নম্বর বাড়িতে, এদিকে আমার নাম হচ্ছে অদ্বৈতচরণ, তাই আমাদের দলের নাম হয়ে গিয়েছিল দ্বৈতাদ্বৈতসম্প্রদায় । আমাদের এই সম্প্রদায়ের কারও সময়-অসময়ের জ্ঞান ছিল না। কেউ-বা পাঞ্চ-করা ট্রামের টিকিট দিয়ে পত্র-চিহ্নিত একখানা নূতন-প্ৰকাশিত ইংরেজি বই হাতে করে সকালে এসে উপস্থিত— তর্ক করতে করতে একটা বেজে যায় ; তবু তর্ক শেষ হয় না । কেউ-বা। সদ্য কলেজের নোট-নেওয়া খাতাখানা নিয়ে বিকেলে এসে হাজির, রাত যখন দুটাে তখনো ওঠবার নাম করে না । আমি প্রায় তাদের খেতে বলি । কারণ, দেখেছি, সাহিত্যচর্চা যারা করে তাদের রসজ্ঞতার শক্তি কেবল মস্তিষ্কে নয়, রসনাতেও খুব প্রবল । কিন্তু, যার ভরসায় এই সমস্ত ক্ষুধিতদের যখন-তখন খেতে বলি তার অবস্থা যে কী হয়, সেটাকে আমি তুচ্ছ বলেই বরাবর মনে করে আসতুম। সংসারে ভাবেব ও জ্ঞানের যে-সকল বড়ো বড়ো কুলালচক্র ঘুরছে, যাতে মানবসভ্যতা কতক-বা তৈরি হয়ে আগুনের পোড় খেয়ে শক্ত হয়ে উঠছে, কতক-বা কঁচা থাকতে থাকতেই ভেঙে ভেঙে পড়ছে, তার কাছে ঘরকন্নার নড়াচড়া এবং রান্নাঘরের চুলোর আগুন কি চোখে পড়ে । ভবানীর ভুকুটিভঙ্গি ভবই জানেন, এমন কথা কাব্যে পড়েছি। কিন্তু ভবের তিন চক্ষু ; আমার একজোড়া মাত্র, তারও দৃষ্টিশক্তি বই পড়ে পড়ে ক্ষীণ হয়ে গেছে। সুতরাং অসময়ে ভোজের আয়োজন করতে বললে আমার স্ত্রীর ভূচাপে কিরকম চাপল্য উপস্থিত হত, তা আমার নজরে পড়ত না। ক্রমে তিনি বুঝে নিয়েছিলেন, আমার ঘরে অসময়ই সময় এবং অনিয়মই নিয়ম । আমার সংসারের ঘড়ি তালিকানা এবং আমার গৃহস্থলির কোটরে কোটরে উনপঞ্চাশ পাবনের বাসা । আমার যা কিছু অর্থ সামর্থ্য তার একটিমাত্র খোলা ড্রেন ছিল, সে হচ্ছে বই-কেনার দিকে ; সংসারের অন্য প্রয়োজন হ্যাংলা কুকুরের মতো এই আমার শখের বিলিতি কুকুরের উচ্ছিষ্ট চোটে ও শুকে কেমন করে যে বেঁচে ছিল, তার রহস্য আমার চেয়ে আমার স্ত্রী বেশি জানতেন । নানা জ্ঞানের বিষয়ে কথা কওয়া আমার মতো লোকের পক্ষে নিতান্ত দরকার । বিদ্যা জাহির