পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪০০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VEbrS রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “তুমি কোথা থেকে শুনলে ?” সে বললে, “পিয়লা-নম্বর থেকে ।” পয়লা-নম্বর থেকে ! বিবরণটা এই-- সন্ধ্যার দিকে অনিলার কাছে যখন খবর এল তখন সে গাড়ি ডাকার অপেক্ষা না করে অযোধ্যাকে সঙ্গে নিয়ে পথের মধ্যে থেকে গাড়ি ভাড়া করে বাপের বাড়িতে গিয়েছিল । অযোধ্যার কাছ থেকে রাত্রে সিতাংশুমীেলী এই খবর পেয়েই তখনি সেখানে গিয়ে পুলিসকে ঠাণ্ডা করে নিজে শ্মশানে উপস্থিত থেকে মৃতদেহের সৎকার করিয়ে দেন । ব্যতিব্যস্ত হয়ে তখনি অন্তঃপুরে গেলুম। মনে করেছিলুম, অনিলা বুঝি দরজা বন্ধ করে আবার তার শোবার ঘরের আশ্রয় নিয়েছে । কিন্তু, এবারে গিয়ে দেখি, ভঁড়ারের সামনের বারান্দায় বসে সে আমড়ার চাটুনির আয়োজন করছে। যখন লক্ষ্য করে তার মুখ দেখলুম। তখন বুঝলুম, এক রাত্রে তার জীবনটা উলট-পালট হয়ে গেছে । আমি অভিযোগ করে বললুম, “আমাকে কিছু বল নি কেন ?” সে তার বড়ো বড়ো দুই চোখ তুলে একবার আমার মুখের দিকে তাকালে- কোনো কথা কইলে না । আমি লজ্জায় অত্যন্ত ছোটাে হয়ে গেলুম। যদি আনিলা বলত ‘‘তোমাকে বলে লাভ কী’, তা হলে আমার জবাব দেবার কিছুই থাকত না । জীবনের এই সব বিপ্লব- সংসারের সুখ দুঃখ- নিয়ে কী ক’রে যে ব্যবহার করতে হয়, আমি কি তার কিছুই জানি । আমি বললুম, “অনিল, এ-সব রাখো, আজ আমাদের সভা হবে না ।” আনিলা আমড়ার খোসা ছাড়াবার দিকে দৃষ্টি রেখে বললে, “কেন হবে না। খুব হবে । আমি এত করে সমস্ত আয়োজন করেছি, সে আমি নষ্ট হতে দিতে পারব না ।” আমি বললুম, “আজ আমাদের সভার কাজ হওয়া অসম্ভব ।” সে বললে, “তোমাদের সভা না হয় না হবে, আজ আমার নিমন্ত্রণ ।” আমি মনে একটু আরাম পেলুম । ভাবলুম, অনিলের শোকটা তত বেশি কিছু নয় । মনে করলুম, সেই- যে এক সময়ে ওর সঙ্গে বড়ো বড়ো বিষয়ে কথা কই,তুমি তারই ফলে ওর মনটা অনেকটা নিরাসক্ত হয়ে এসেছে। যদিচ সব কথা বোঝবার মতো শিক্ষা এবং শক্তি ওর ছিল না, কিন্তু তবু পার্সোনাল ম্যাগনেটিজম বলে একটা জিনিস আছে তো । সন্ধ্যার সময় আমার দ্বৈতদলের দুই-চারজন কম পড়ে গেল। কানাই তো এলই না । পয়লা-নম্বরে যারা টেনিসের দলে যোগ দিয়েছিল তারাও কেউ আসে নি। শুনলুম, কাল ভোরের গাড়িতে সিতাংশুমীেলী চলে যাচ্ছে, তাই এরা সেখানে বিদায়ভোজ খেতে গেছে । এ দিকে অনিলা আজ যেরকম ভোজের আয়োজন করেছিল এমন আর কোনো দিনই করে নি । এমন-কি, আমার মতো বেহিসাবি লোকেও এ কথা না মনে করে থাকতে পারে নি যে, খরচটা অতিরিক্ত করা হয়েছে । সেদিন খাওয়াদাওয়া করে সভা ভঙ্গ হতে রাত্রি একটা-দেড়টা হয়ে গেল । আমি ক্লান্ত হয়ে তখনি শুতে গেলুম । অনিলাকে জিজ্ঞাসা করলুম, “শোবে না ?” সে বললে, “বাসনগুলো তুলতে হবে ।” পরের দিন যখন উঠলুম। তখন বেলা প্রায় আটটা হবে। শোবার ঘরে টিপাইয়ের উপর যেখানে আমার চশমাটা খুলে রাখি সেখানে দেখি, আমার চশমা চাপা দেওয়া একা-টুকরা কাগজ, তাতে অনিলের হাতের লেখাটি আছে। “আমি চললুম। আমাকে খুঁজতে চেষ্টা কোরো না। করলেও খুঁজে • नां ॥' কিছু বুঝতে পারলুম না। টিপাইয়ের উপরে একটা টিনের বাক্স- সেটা খুলে দেখি, তার মধ্যে আনিলার সমন্ত গয়না- এমন-কি, তার হাতের চুড়ি বালা পর্যন্ত, কেবল তার শাখা এবং হাতের লোহা ছাড়া। একটা খোপের মধ্যে চাবির গোছা, অন্য অন্য খোপে কাগজের-মোড়কে-করা কিছু টাকা সিকি দুয়ানি । অৰ্থাৎ, মাসের খরচ বাচিয়ে অনিলের হাতে যা কিছু জন্মেছিল তার শেষ পয়সাটি পর্যন্ত রেখে গেছে। একটি খাতায় বাসন-কোসন জিনিসপত্রের ফর্দ, এবং ধোবার বাড়িতে যে-সব কাপড় গেছে