পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Ve3 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সময় সে বললে, “আমাকে বিবাহ দেবার জন্যে আপনি কোনো চেষ্টা করবেন না ।” আর যাই হােক, দীপালির মুখে এমন আপত্তি আমি প্রত্যাশাই করি নি। আমি ভেবে রেখেছিলুম, বিবাহের প্রস্তাবে তার দেহ মন প্ৰাণ কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠেছে। জিজ্ঞাসা করলুম, “জানা অজানা কোনাে পাত্ৰকেই তুমি বিবাহ করবে না ?” সে বললে, “না, কোনো পাত্ৰকেই না ।” যদিচ মনন্তত্ত্বের চেয়ে বস্তুতন্ত্ৰেই আমার অভিজ্ঞতা বেশি-বিশেষত নারীচিত্ত আমার কাছে বাংলা বানানের চেয়ে কঠিন, তবু কথাটার সাদা অর্থ আমার কাছে সত্য অর্থ বলে মনে হল না। আমি বললুম, “যে-পাত্র আমি তোমার জন্যে বেছেছি। সে অবজ্ঞা করবার যোগ্য নয়।” দীপালি বললে, “আমি তাকে অবজ্ঞা করি নে, কিন্তু আমি বিবাহ করব না ।” আমি বললুম, “সে লোকটিও তোমাকে মনের সঙ্গে শ্রদ্ধা করে।” “কিন্তু, না, আমাকে বিবাহ করতে বলবেন না ।” “আচ্ছা, বলব না, কিন্তু আমি কি তোমাদের কোনো কাজে লাগতে পারি। নে ৷” “আমাকে যদি কোনো মেয়ে-ইস্কুলে পড়বার কাজ জুটিয়ে দিয়ে এখান থেকে কলকাতায় নিয়ে যান তা হলে ভারি উপকার হয় ।” বললুম, “কাজ আছে, জুটিয়ে দিতে পারব।” এটা সম্পূর্ণ সত্য কথা নয়। মেয়ে-ইস্কুলের খবর আমি কী জানি । কিন্তু, মেয়ে-ইস্কুল স্থাপন করতে তো দোষ নেই । দীপালি বললে, “আপনি আমাদের বাড়ি গিয়ে একবার মায়ের সঙ্গে এ কথার আলোচনা করে। দেখবেন ?” আমি বললুম, “আমি কাল সকালেই যাব।” দীপালি চলে গেল। কাগজ-পড়া আমার বন্ধ হল। ছাতের উপর বেরিয়ে এসে চৌকিতে বসলুম। তারাগুলোকে জিজ্ঞাসা করলুম, “কোটি কোটি যোজন দূরে থেকে তোমরা কি সত্যই মানুষের জীবনের সমস্ত কর্মসূত্র ও সম্বন্ধসূত্র নিঃশব্দে বসে বসে বুনছ।” এমন সময়ে কোনাে খবর না দিয়ে হঠাৎ বিশ্বাপতির মেজো ছেলে শ্ৰীপতি ছাতে এসে উপস্থিত। তার সঙ্গে যে-আলোচনাটা হল, তার মর্ম এই-- শ্ৰীপতি দীপালিকে বিবাহ করবার আগ্রহে সমাজ ত্যাগ করতে প্ৰস্তুত । বাপ বলেন, এমন দুষ্কার্য করলে তিনি তাকে ত্যাগ করবেন। দীপালি বলে, তার জন্যে এত বড়ো দুঃখ অপমান ও ত্যাগ স্বীকার কেউ করবে, এমন যোগ্যতা তার নেই। তা ছাড়া শ্ৰীপতি শিশুকাল থেকে ধনীগৃহে লালিত ; দীপালির মতে, সে সমাজচু্যত এবং নিরাশ্রয় হয়ে দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। এই নিয়ে তর্ক চলছে, কিছুতে তার মীমাংসা হচ্ছে না । ঠিক এই সংকটের সময় আমি মাঝখানে পড়ে এদের মধ্যে আর-একটা পাত্রকে খাড়া করে সমস্যার জটিলতা অত্যন্ত বাড়িয়ে তুলেছি। এইজন্যে শ্ৰীপতি আমাকে এই নাটকের থেকে প্রুফশিটের কাটা অংশের মতো বেরিয়ে যেতে " বলছে । আমি বললুম, “যখন এসে পড়েছি তখন বেরোচ্ছি নে। আর, যদি বেরোই তা হলে গ্ৰন্থি কেটে তবে বেরিয়ে পড়ব ।” বিবাহের দিনপরিবর্তন হল না। কেবলমাত্র পাত্ৰপরিবর্তন হল। বিশ্বাপতির অনুনয় রক্ষা করেছি কিন্তু তাতে তিনি সন্তুষ্ট হন নি । দীপালির অনুনয় রক্ষা করি নি। কিন্তু ভাবে বোধ হল, সে সন্তুষ্ট হয়েছে। ইস্কুলে কাজ খালি ছিল কি না জানি নে কিন্তু আমার ঘরে কন্যার স্থান শূন্য ছিল, সেটা পূর্ণ হল । আমার মতো বাজে লোক যে নিরর্থক নয়। আমার অর্থই সেটা শ্ৰীপতির কাছে প্ৰমাণ করে দিলে। তার গৃহদ্দীপ আমার কলকাতার বাড়িতেই জ্বলল। ভেবেছিলুম, সময়মত বিবাহ না সেরে রাখার মুলতবি অসময়ে বিবাহ করে পূরণ করতে হবে, কিন্তু দেখলুম, উপরওয়ালা প্ৰসন্ন হলে দুটো-একটা ক্লাস ডিঙিয়েও প্রোমোশন পাওয়া যায় । আজ পঞ্চান্ন বছর বয়সে আমার ঘর নাতনিতে