পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪১৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

*@5豪 KOS A ভুগল সেই কেবল ভুগল। আর, মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ, রস পেলে দশে মিলে । সেও বেশিক্ষণ নয় ; নাট্যমঞ্চের পর্দা পড়ে যায়, আলো নেভে, তার পরে ভোলবার পালা । কেবল বেড়ি-হাতকড়ার দাগ যার হাড়ে গিয়ে লেগেছে তারই চিরদিন মনে থাকে । পিসিমা এখনো তীর্থে। কোথায়, তার ঠিকানাও জানি নে । ইতিমধ্যে পুজোর সময় কাছে এল । একদিন সকালবেলায় আমার সম্পাদক-বন্ধু এসে উপস্থিত । বললেন, “ওহে, পুজোর সংখ্যার জন্যে একটা লেখা চাই ।” “জিজ্ঞাসা করলেম, কবিতা ।” “আরে, না । তোমার জীবনবৃত্তান্ত ।” “ সে তো তোমার এক সংখ্যায় ধরবে না ।” “এক সংখ্যায় কেন । ক্ৰমে ক্ৰমে বেরোবে ।” “সতীর মৃতদেহ সুদর্শনচক্রে টুকরো টুকরো করে ছড়ানো হয়েছিল । আমার জীবনচরিত সম্পাদকি চক্রে তেমনি টুকরো টুকরো করে সংখ্যায় সংখ্যায় ছড়িয়ে দেবে, এটা আমার পছন্দসই নয় । জীবনী যদি লিখি গোটা আকারে বের করে দেব ।” “না-হয় তোমার জীবনের কোনো-একটা বিশেষ ঘটনা লিখে দাও-না ।” “কী রকম ঘটনা ।” “তোমার সব চেয়ে কঠোর অভিজ্ঞতা, খুব যাতে ঝাজ ।” “এত কৌতুহল ? আচ্ছা, বেশ, লিখব।” “মনে থাকে যেন সব চেয়ে যেটাতে তোমার কঠোর অভিজ্ঞতা ।” “অর্থাৎ, সব চেয়ে যেটাতে দুঃখ পেয়েছি, লোকের তাতেই সব চেয়ে মজা । আচ্ছা, বেশ । কিন্তু নামটামগুলো অনেকখানি বানাতে হবে ।” “তা তো হবেই । যেগুলো একেবারে মারাত্মক কথা তার ইতিহাসের চিহ্ন বদল না করলে বিপদ আছে । আমি সেইরকম মরিয়াগোছের জিনিসই চাই । পেজ প্ৰতি তোমাকে-” “আগে লেখাটা দেখো, তার পরে দরদস্তুর হবে ।” t “কিন্তু, আর-কাউকে দিতে পারবে না বলে রাখছি। যিনি যত দর হাকুন, আমি তার উপরে-” “আচ্ছা, আচ্ছা, সে হবে ।” শেষকালটা উঠে যাবার সময় বলে গেলেন, “তোমাদের ইনি- বুঝতে পারছি ? নাম করব নাঐ-যে তোমাদের সাহিত্যধুরন্ধর- মন্ত লেখক বলে বড়াই ; কিন্তু, যা বল তোমার স্টাইলের কাছে তার স্টাইল যেন ডসনের বুট আর তালতলার চটি ।” বুঝলেম, আমাকে উপরে চড়িয়ে দেওয়াটা উপলক্ষ মাত্র, তুলনায় ধুরন্ধারকে নাবিয়ে দেওয়াটাই লক্ষ্য । এই গেল আমার ভূমিকা। এইবার আমার কঠোর অভিজ্ঞতার কাহিনী । “সন্ধ্যা’ কাগজ যেদিন থেকে পড়তে শুরু, সেইদিন থেকেই আহারবিহার সম্বন্ধে আমার কড়া ভোগ । সেটাকে জেলযাত্রার রিহার্সাল বলা হত । দেহের প্রতি অনাদরের অভ্যাস পাকা হয়ে উঠল । তাই প্ৰথমবার যখন ঠেলিলে হাজতে, প্ৰাণপুরুষ বিচলিত হয় নি। তার পর বেরিয়ে এসে নিজের পরে কারও সেবাশুশ্ৰুষার হস্তক্ষেপমাত্র বরদান্ত করি নি । পিসিমা দুঃখবোধ করতেন। তাকে বলতেম, “পিসিমা, স্নেহের মধ্যে মুক্তি, সেবার মধ্যে বন্ধন । তা ছাড়া, একের শরীরে অন্য শরীরধারীর আইন খাটানোকে বলে ডায়ার্কি, দ্বৈরাজ্য- সেইটের বিরুদ্ধে আমাদেয় অসহযোগ ।” তিনি নিশ্বাস ছেড়ে বলতেন, “আচ্ছা, বাবা, তোমাকে বিরক্ত করব না ।”