পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Test 8○○ পক্ষে স্বাস্থ্যকর নয় । f বাড়ি থেকে অল্প একটু বেরিয়েছি। যেখানে রাস্তার ধারে কলতলা পেরিয়ে খোলার চালের ধারে স্কুলোদর হিন্দুস্থানী ময়রার দোকানে তেলে-ভাজা নানা প্রকার অপথ্য সৃষ্টি হচ্ছে, তার সামনে এসে দেখি বিষম একটা হাল্লা । আমাদের প্রতিবেশী মাড়োয়ারিরা নানা বহুমূল্য পুজোপচার নিয়ে যাত্রা করে সবে-মাত্র বেরিয়েছে। এমন সময় এই জায়গাটাতে এসে ঠেকে গেল । শুনতে পেলেম মারি-মার। ধ্বনি । মনে ভাবলুম, কোনো গাটকাটাকে শাসন চলছে। মোটরের শিঙা ফুকতে ফুকতে উত্তেজিত জনতার কেন্দ্রের কাছে গিয়ে দেখি, আমাদের পাড়ার বুড়ো সরকারি মেথরটাকে বেদম মারছে। একটু আগেই রাস্তার কালতলায় স্নান সেরে সাফ কাপড় পরে ডান হাতে এক বালতি জল ও বগলে বঁটা নিয়ে রাস্তা দিয়ে সে যাচ্ছিল । গায়ে চেক-কাটা মেরজাই, আঁচড়ানো চুল ভিজে ; বা হাত ধরে সঙ্গে চলেছিল আট-নয় বছরের এক নাতি । দুজনকেই দেখতে সুশ্ৰী, সুঠাম দেহ । সেই ভিড়ে কারও সঙ্গে বা কিছুর সঙ্গে তাদের ঠেকাঠেকি হয়ে থাকবে । তার থেকে এই নিরন্তর মারের সৃষ্টি । নাতিটা কঁদছে আর সকলকে অনুনয় করছে, “দাদাকে মেরো না।” বুড়োটা হাত জোড় করে বলছে, “দেখতে পাই নি, বুঝতে পারি নি, কসুর মাফ করো ।” অহিংসাব্রত পুণ্যাখীদের রাগ চড়ে উঠছে। বুড়োর ভীত চোখ দিয়ে জল পড়ছে, দাড়ি দিয়ে রক্ত । আমার আর সহ্য হয় না। ওদের সঙ্গে কলহ করতে নামা আমার পক্ষে অসম্ভব । স্থির করলুম, মেথরকে আমার নিজের গাড়িতে তুলে নিয়ে দেখাব আমি ধামিকদের দলে নই। চঞ্চলতা দেখে কলিকা আমার মনের ভাব বুঝতে পারলে । জোর করে আমার হাত চেপে ধরে বললে, “করছি কী, ও যে মেথর ” আমি বললুম, “হােক-না মেথর, তাই বলে ওকে অন্যায় মারবে ?” কলিকা বললে, “ওরই তো দোষ । রাস্তার মাঝখান দিয়ে যায় কেন । পাশ কাটিয়ে গেলে কি ওর মানহানি হত ।” আমি বললুম, “সে আমি বুঝি নে, ওকে আমি গাড়িতে তুলে নেবই ।” কলিকা বললে, “তা হলে এখনই এখানে রাস্তায় নেমে যাব । মেথরকে গাড়িতে নিতে পারব নাহাড়িডোম হলেও বুঝতুম, কিন্তু মেথর ।” আমি বললুম, “দেখছ-না, স্নান করে ধোপ-দেওয়া কাপড় পরেছে ? এদের অনেকের চেয়ে ও পরিষ্কার ।” “তা হােক-না, ও যে মেথর !” শোফারকে রিললে, “গঙ্গাব্দীন, হাকিয়ে চলে যাও ।” আমারই হার হল । আমি কাপুরুষ । নয়নমোহন সমাজতত্ত্বঘটিত গভীর যুক্তি বের করেছিল- সে আমার কানে পৌঁছল না, তার জবাবও দিই নি । । মাদ্ৰাজ ।। ১ জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৫ Vi5 S \ood বলাই মানুষের জীবনটা পৃথিবীর নানা জীবের ইতিহাসের নানা পরিচ্ছেদের উপসংহারে, এমন একটা কথা আছে । লোকালয়ে মানুষের মধ্যে আমরা নানা জীবজন্তুর প্রচ্ছন্ন পরিচয় পেয়ে থাকি, সে কথা জানা । বস্তুত আমরা মানুষ বলি সেই পদার্থকে যেটা আমাদের ভিতরকার সব জীবজন্তুকে মিলিয়ে এক করে নিয়েছে- আমাদের বাঘ-গোরুকে এক খোয়াড়ে দিয়েছে পুরে, অহি-নকুলকে এক খাচায় ধরে