পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪২৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 SO রবীন্দ্র-রচনাবলী তো বড়ো সুন্দর হয়েছে।” একদিন একটা মানুষের ছবিকে উলটিয়ে ধরে তার পা দুটােকে পাখির মুণ্ড বলে স্থির করলেন ; বললেন, “সতু, এটা কিন্তু বাধিয়ে রাখা চাই- বকের ছবি যা হয়েছে চমৎকার ” মুকুন্দ তার স্ত্রীর চিত্ররচনায় ছেলেমানুষি কল্পনা করে মনে মনে যে-রসাটুকু পেতেন, স্ত্রী ও তার স্বামীর চিত্ৰবিচার থেকে ভোগ করতেন। সেই একই রস । সত্যবতী মনে নিশ্চিত জানতেন বাংলাদেশের আর-কোনো পরিবারে তিনি এত ধৈৰ্য, এত প্রশ্রয় আশা করতে পারতেন না । শিল্পীসাধনায় তার এই দুনিবার উৎসাহকে কোনো ঘরে এত দরদের সঙ্গে পথ ছেড়ে দিত না । এইজন্যে যেদিন তার স্বামী র্তার কোনো রচনা নিয়ে অদ্ভুত অত্যুক্তি করতেন সেদিন সত্যবতী যেন চোখের জল সামলাতে १°0 | এমন দুর্লভ সৌভাগ্যকেও সত্যবতী একদিন হারালেন। মৃত্যুর পূর্বে উঠার স্বামী একটা কথা স্পষ্ট করে বুঝেছিলেন যে, তার ঋণজড়িত সম্পত্তির ভার এমন কোনো পাকা লোকের হাতে দেওয়া দরকার যার চালনার কৌশলে ফুটাে নীেকেও পার হয়ে যাবে। এই উপলক্ষে সত্যবতী এবং তার ছেলেটি সম্পূর্ণভাবে গিয়ে পড়লেন গোবিন্দর হাতে । গোবিন্দ প্রথম দিন থেকেই জানিয়ে দিলেন, সর্বাগ্রে এবং সকলের উপরে পয়সা । গোবিন্দর এই উপদেশের মধ্যে এমন একটা সুগভীর হীনতা ছিল যে, সত্যবতী লজ্জায় কুষ্ঠিত হত । তবু নানা আকারে আহারে-ব্যবহারে পয়সার সাধনা চলল। তা নিয়ে কথায় কথায় আলোচনা না করে তার উপরে যদি একটা আৰু থাকত তা হলে ক্ষতি ছিল না । সত্যবতী মনে মনে জানতেন, এতে র্তার ছেলের মনুষ্যত্ব খর্ব করা হয়— কিন্তু সহ্য করা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না ; কেননা, যে-চিত্তভাব সুকুমার, যার মধ্যে একটি অসামান্য মর্যাদা আছে, সেই সব চেয়ে অরক্ষিত ; তাকে আঘাত করা, বিদ্রুপ করা, সাধারণ রূঢ়স্বভাব মানুষের পক্ষে অত্যন্ত সহজ । শিল্পচর্চার জন্যে কিছু কিছু উপকরণ আবশ্যক । এতকাল সত্যবতী তা না চাইতেই পেয়েছেন, সেজন্যে কোনোদিন তাকে কুষ্ঠিত হতে হয় নি । সংসারযাত্রার পক্ষে এই সমস্ত অনাবশ্যক সামগ্ৰী, ব্যয়ের ফর্দেী ধরে দিতে আজ যেন তার মাথা কাটা যায় । তাই তিনি নিজের আহারের খরচ বাচিয়ে গোপনে শিল্পের সরঞ্জাম কিনিয়ে আনাতেন । যা-কিছু কাজ করতেন সেও গোপনে দরজা বন্ধ করে । ভৎসনার ভয়ে নয়, অরসিকের দৃষ্টিপাতের সংকোচে । আজ চুনি ছিল তার শিল্পরচনার একমাত্র দর্শক। ও বিচারকারী । এই কাজে ক্রমে তার সহযোগিতাও ফুটে উঠল । তাকে লাগল বিষম নেশা । শিশুর এ অপরাধ ঢাকা পড়ে না, খাতার পাতাগুলো অতিক্রম করে দেয়ালের গায়ে পর্যন্ত প্ৰকাশ হতে থাকে । হাতে মুখে জামার হাতায় কলঙ্ক ধরা পড়ে। পয়সা-সাধনার বিরুদ্ধে ইন্দ্ৰদেব শিশুর চিত্তকেও প্ৰলুব্ধ করতে ছাড়েন না । খুড়োর হাতে অনেক দুঃখ তাকে পেতে হল । এক দিকে শাসন যতই বাড়তে চলল আর-এক দিকে মা তাকে ততই অপরাধে সহায়তা করতে লাগলেন । আপিসের বড়োসাহেব মাঝে মাঝে আপিসের বড়োবাবুকে নিয়ে আপন কাজে মফস্বলে যেতেন, সেই সময়ে মায়েতে ছেলেতে মিলে অবাধ আনন্দ । একেবারে ছেলেমানুষির একশেষ ! যে-সব জন্তুর মূর্তি হত বিধাতা এখনো তাদের সৃষ্টি করেন নি- বেড়ালের ছাচের সঙ্গে কুকুরের ছাচ যেত মিলে, এমন-কি, মাছের সঙ্গে পাখির প্রভেদ ধরা কঠিন হত। এই সমস্ত সৃষ্টিকার্য রক্ষা করবার উপায় ছিল না- বড়োবাবু ফিরে আসবার পূর্বেই এদের চিহ্ন লোপ করতে হত। এই দুজনের সৃষ্টিলীলায় ব্ৰহ্মা এবং রুদ্রই ছিলেন, মাঝখানে বিষ্ণুর আগমন হল না । শিল্পরচনাবায়ুর প্রকোপ সত্যবতীদের বংশে প্রবল ছিল । তারই প্রমাণস্বরূপে সত্যবতীর চেয়ে বয়সে বড়ো তারই এক ভাগনে রঙ্গলাল চিত্রবিদ্যায় হঠাৎ নামজাদা হয়ে উঠলেন । অর্থাৎ, দেশের রসিক লোক তার রচনার অদ্ভুতত্ব নিয়ে খুব অট্টহাস্য জমালে । তারা যে-রকম কল্পনা করে তার সঙ্গে তার কল্পনার মিল হয় না দেখে তার গুণপনার সম্বন্ধে তাদের প্রচণ্ড অবজ্ঞা হল । আশ্চর্য এই যে, এই অবজ্ঞার জমিতেই বিরোধ-বিদ্রুপের আবহাওয়ায় তঁর খ্যাতি বেড়ে উঠতে লাগল ; যারা তার যতই নকল করে তারাই উঠে পড়ে লাগল প্রমাণ করতে যে, লোকটা আর্টিস্ট হিসাবে ফাঁকি- এমন-কি,