পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৩০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 S SR রবীন্দ্র-রচনাবলী “এখান থেকে বেরিয়ে যাই ।” রঙ্গলালের দরজায় এক-হাঁটু জল। সত্যবতী চুনিলালকে নিয়ে তার ঘরে ঢুকলেন ; বললেন, “বাবা, তুমি নাও এর ভার। বাচাও একে পয়সার সাধনা থেকে ৷” কার্তিক ১৩৩৬ চোরাই ধন মহাকাব্যের যুগে স্ত্রীকে পেতে হত পৌরুষের জোরে ; যে অধিকারী সেই লাভ করত। রমণীরত্ব । আমি লাভ করেছি কাপুরুষতা দিয়ে, সে কথা আমার স্ত্রীর জানতে বিলম্ব ঘটেছিল । কিন্তু, সাধনা করেছি বিবাহের পরে, যাকে ফাকি দিয়ে চুরি করে পেয়েছি তার মূল্য দিয়েছি দিনে দিনে । দাম্পত্যের স্বত্ব সাব্যস্ত করতে হয় প্রতিদিনই নতুন করে, অধিকাংশ পুরুষ ভুলে থাকে এই কথাটা । তারা গোড়াতেই কাস্টম হীেসে মাল খালাস করে নিয়েছে সমাজের ছাড়চিঠি দেখিয়ে, তার পর থেকে আছে। বেপরোয়া । যেন পেয়েছে পাহারাওয়ালার সরকারি প্রতাপ, উপরওয়ালার দেওয়া তকমার জোরে ; উর্দটা খুলে নিলেই অতি অভাজন তারা । বিবাহটা চিরজীবনের পালাগান ; তার ধুয়ো একটামাত্র, কিন্তু সংগীতের বিস্তার প্রতিদিনের নব নব পর্যায়ে । এই কথাটা ভালোরকম করে বুঝেছি সুনেত্রার কাছ থেকেই। ওর মধ্যে আছে ভালোবাসার ঐশ্বৰ্য, ফুরোতে চায় না। তার সমারোহ ; দেউড়িতে চার-প্রহর বাজে তার সাহানা রাগিণী । আপিস থেকে ফিরে এসে একদিন দেখি আমার জন্যে সাজানো আছে বরফ-দেওয়া ফলসার শরবত, রঙ দেখেই মনটা চমকে ওঠে ; তার পাশেই ছোটো রুপোর থালায় গোড়ে মালা, ঘরে ঢোকবার আগেই গন্ধ আসে এগিয়ে । আবার কোনোদিন দেখি আইসক্রিমের যন্ত্রে জমানো শাসে রসে মেশানো তালাশাস এক-পেয়ালা, আর পিরিচে একটিমাত্র সূর্যমুখী । ব্যাপারটা শুনতে বেশি কিছু নয়, কিন্তু বোঝা যায়, দিনে দিনে নতুন করে সে অনুভব করেছে আমার অস্তিত্ব। এই পুরোনোকে নতুন করে অনুভব করার শক্তি আটিস্টের। আর ইতরে জন্যঃ প্রতিদিন চলে দস্তুরের দাগা বুলিয়ে। ভালোবাসার প্ৰতিভা সুনেত্রার নবনবোন্মেষশালিনী সেবা। আজ আমার মেয়ে অরুণার বয়স সতেরো, অর্থাৎ ঠিক যে-বয়সে বিয়ে হয়েছিল সুনেত্রার । ওর নিজের বয়স আটত্রিশ, কিন্তু সযত্নে সাজসজ্জা করাটাকে ও জানে প্রতিদিন পুজোর নৈবেদ্য-সাজানো, আপনাকে উৎসর্গ করবার। আহ্নিক অনুষ্ঠান । সুনেত্ৰা ভালোবাসে শান্তিপুরে সাদা শাড়ি কালো পাড়ওয়ালা । খদ্দর প্রচারকদের ধিক্কারকে বিনা প্রতিবাদে স্বীকার করে নিয়েছে ; কিছুতেই স্বীকার করে নি খদ্দরকে । ও বলে দিশি তাতির হাত, দিশি তাতির তাত, এই আমার আদরের । তারা শিল্পী, তাদেরই পছন্দে সুতো, আমার পছন্দ সমস্ত কাপড়টা নিয়ে । আসল কথা, সুনেত্রা বোঝে হালকা সাদা রঙের শাড়িতে সকল রঙেরই ইশারা খাটে সহজে । ও সেই কাপড়ে নূতনত্ব দেয় নানা আভাসে, মনে হয় না। সেজেছে । ও বোঝে, আমার অবচেতন মনের দিগন্ত উদভাসিত হয় ওর সাজে- আমি খুশি হই, জানি নে কেন খুশি হয়েছি। প্রত্যেক মানুষেই আছে। একজন আমি, সেই অপরিমেয় রহস্যের অসীম মূল্য জোগায় ভালোবাসায় । অহংকারের মেকি পয়সা তুচ্ছ হয়ে যায়। এর কাছে। সুনেত্ৰা আপন মনপ্ৰাণ দিয়ে এই পরম মূল্য দিয়ে এসেছে আমাকে, আজ একুশ বছর ধরে । ওর শুভ্রললাটের কুকুমবিন্দুর মধ্যে প্রতিদিন লেখা হয় অক্লান্ত বিস্ময়ের বাণী । ওর নিখিল জগতের মর্মস্থান অধিকার করে আছি। আমি, সেজন্যে আমাকে আর-কিছু হতে হয় নি। সাধারণ জগতে যে-কেউ হওয়া ছাড়া । সাধারণকেই অসাধারণ করে আবিষ্কার করে ভালোবাসা । শাস্ত্ৰে বলে, আপনাকে জানো । আনন্দে আপনাকেই জানি, আর-একজন যখন প্ৰেমে জেনেছে আমার আপনাকে ।