পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 SR SR রবীন্দ্র-রচনাবলী তখন মনে এল, এতদিন যা উলটাে করে বলছিলুম তাই সোজা করে বলার দরকার । বলতুম, সুন্দর আনন্দ দেয়, তাই সাহিত্যে সুন্দরকে নিয়ে কারবার । বস্তুত বলা চাই, যা আনন্দ দেয় তাকেই মন সুন্দর বলে, আর সেটাই সাহিত্যের সামগ্ৰী । সাহিত্যে কী দিয়ে এই সৌন্দর্যের বোধকে জাগায় সে কথা গৌণ, নিবিড় বোধের দ্বারাই প্ৰমাণ হয় সুন্দরের । তাকে সুন্দর বলি বা না-বলি তাতে কিছু আসে-যায় না, বিশ্বের অনেক উপেক্ষিতের মধ্যে মন তাকেই অঙ্গীকার করে নেয় । সাহিত্যের বাইরে এই সুন্দরের ক্ষেত্ৰ সংকীর্ণ । সেখানে প্রাণতত্ত্বের অধিকৃত মানুষকে অনিষ্টকর কিছুতে আনন্দ দেয় না। সাহিত্যে দেয়, নইলে ‘ওথেলো’ নাটককে কেউ ছুতে পারত না । এই প্রশ্ন আমার মনকে উদবেজিত করেছিল যে, সাহিত্যে দুঃখকর কাহিনী কেন আনন্দ দেয় এবং সেই কারণে কেন তাকে সৌন্দর্যের কোঠায় গণ্য করি । মনে উত্তর এল, চারি দিকের রসহীনতায় আমাদের চৈতন্যে যখন সাড় থাকে না। তখন সেই অস্পষ্টতা দুঃখকর । তখন আত্মোপলব্ধি স্নান । আমি যে আমি, এইটে খুব করে যাতেই উপলব্ধি করায় তাতেই আনন্দ । যখন সামনে বা চারি দিকে এমন-কিছু থাকে যার সম্বন্ধে উদাসীন নই, যার উপলব্ধি আমার চৈতন্যকে উদবোধিত করে রাখে, তার আস্বাদনে আপনাকে নিবিড় করে পাই। এইটের অভাবে অবসাদ । বস্তুত, মন নাস্তিত্বের দিকে যতই যায় ততই তার দুঃখ । দুঃখের তীব্ৰ উপলব্ধিও আনন্দকর, কেননা সেটা নিবিড় অস্মিতাসূচক ; কেবল অনিষ্টের আশঙ্কা এসে বাধা দেয় । সে আশঙ্কা না থাকলে দুঃখকে বলতুম সুন্দর । দুঃখে৷ আমাদের স্পষ্ট করে তোলে, আপনার কাছে আপনাকে ঝাপসা থাকতে দেয় না । গভীর দুঃখ ভূমা ; ট্র্যাজেডির মধ্যে সেই ভূমা আছে, সেই ভূমৈব সুখম । মানুষ বাস্তব জগতে ভয় দুঃখ বিপদকে সর্বতোভাবে বর্জনীয় বলে জানে, অথচ তার আত্ম-অভিজ্ঞতাকে প্ৰবল এবং বহুল করবার জন্যে এদের না পেলে তার স্বভাব বঞ্চিত হয় । আপন স্বভাবগত এই চাওয়াটাকে মানুষ সাহিত্যে আর্টে উপভোগ করছে। একে বলা যায় লীলা, কল্পনায় আপনার অবিমিশ্র উপলব্ধি । রামলীলায় মানুষ যোগ দিতে যায় খুশি হয়ে ; লীলা যদি না হত। তবে বুক যেত ফেটে । এই কথাটা যেদিন প্ৰথম স্পষ্ট করে মনে এল সেদিন কবি কীটসের বাণী মনে *yai : Truth is beauty, beauty truth Safe, Gri 'SG STNKT Zan Afri মনসা’ উপলব্ধি করি তাই সুন্দর । তাতেই আমরা আপনাকে পাই । এই কথাই যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন যে, যে-কোনো জিনিস আমার প্ৰিয় তার মধ্যে আমি আপনাকেই সত্য করে পাই ব’লেই তা প্রিয়, তাই সুন্দর । মানুষ আপনার এই প্ৰিয়ের ক্ষেত্ৰকে, অর্থাৎ আপনি সুস্পষ্ট উপলব্ধির ক্ষেত্ৰকে, সাহিত্যে প্রতিদিন বিস্তীর্ণ করছে। তার বাধাহীন বিচিত্র বৃহৎ লীলার জগৎ সাহিত্যে । সৃষ্টিকর্তাকে আমাদের শাস্ত্রে বলেছে লীলাময় । অর্থাৎ, তিনি আপনার রসবিচিত্র পরিচয় পাচ্ছেন আপনি সৃষ্টিতে। মানুষও আপনার মধ্যে থেকে আপনাকে সৃষ্টি করতে করতে নানা ভাবে নানা রসে আপনাকে পাচ্ছে । মানুষও লীলাময় । মানুষের সাহিত্যে আর্টে সেই লীলার ইতিহাস লিখিত অঙ্কিত হয়ে চলেছে । ইংরেজিতে যাকে বলে real সাহিত্যে আর্টে সেটা হচ্ছে তাই যাকে মানুষ আপন অন্তর থেকে অব্যবহিতভাবে স্বীকার করতে বাধ্য। তর্কের দ্বারা নয়, প্রমাণের দ্বারা নয়,