পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে বাস্তব লোকেরা কিছুই ঠিকমত করিতেছে না, সংসারে যেমন হওয়া উচিত ছিল তেমন হইতেছে না, সময় খারাপ পড়িয়াছে- এই সমস্ত দুশ্চিন্তা প্রকাশ করিয়া মানুষ দিব্য আরামে থাকে, তাহার আহারনিদ্রার কিছুমাত্র ব্যাঘাত হয় না, এটা প্রায়ই দেখিতে পাওয়া যায়। দুশ্চিন্তা-আগুনটা শীতের আগুনের মতো উপাদেয়, যদি সেটা পাশে থাকে। কিন্তু নিজের গায়ে না লাগে । অতএব, যদি এমন কথা কেহ বলিত যে, আজকাল বাংলাদেশে কবিরা যে সাহিত্যের সৃষ্টি করিতেছে তাহাতে বাস্তবতা নাই, তাহা জনসাধারণের উপযোগী নহে, তাহাতে লোকশিক্ষার কাজ চলিবে না, তবে খুব সম্ভব, আমিও দেশের অবস্থা সম্বন্ধে উদবেগ প্রকাশ করিয়া বলিতাম, কথাটা ঠিক বটে ; এবং নিজেকে এই দলের বাহিরে ফেলিতাম | কিন্তু, একেবারে আমারই নাম ধরিয়া এই কথাগুলি প্রয়োগ করিলে অন্যের তাহাতে যতই আমোদ হােক, আমি সে আমোদে খোলা মনে যোগ দিতে পারি না । তবে কিনা, বাসরঘরে বর এবং পাঠকসভায় লেখকের প্রায় একই দশা । কৰ্ণমূলে অনেক কঠিন কৌতুকে উভয়কে নিঃশব্দে সহ্য করিতে হয় । সহ্য যে করে তাহার কারণ এই, একটা জায়গায় তাহাদের জিত আছে। যে যতই উৎপীড়ন করুক, যে বর তাহার কনেটিকে কেহ হরণ করিবে না ; এবং যে লেখক তাহার লেখাটা তো রহিলাই । অতএব, নিজের সম্বন্ধে কিছু বলিব না। কিন্তু, এই অবকাশে সাধারণভাবে সাহিত্য-সম্বন্ধে কিছু বলা যাইতে পারে । তাহা নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক হইবে না । কেননা, যদিচ প্ৰথম নম্বরেই আমার লেখাটাকে সেসনে সোপরদ করা হইয়াছে। তবু এ খবরটারিও আভাস আছে যে, আজকালকার প্রায় সকল লেখকেরই এই একই অপরাধ । বাস্তবতা না থাকা নিশ্চয়ই একটা মন্ত ফাকি । বস্তু কিছুই পাইল না। অথচ দাম দিল এবং খুশি হইয়া হাসিতে হাসিতে গেল, এমন-সব হতবুদ্ধি লোকের জন্য পাকা অভিভাবক নিযুক্ত হওয়া উচিত। সেই লোকেই অভিভাবকের উপযুক্ত, কবিরা ফাঁস করিয়া যাহাদিগকে কলাকৌশলে ঠিকাইতে না পারে, কটাক্ষে যাহারা বুঝিতে পারে বস্তু কোথায় আছে এবং কোথায় নাই। অতএব, র্যাহারা অবাস্তব-সাহিত্য সম্বন্ধে দেশকে সতর্ক করিয়া দিতেছেন, তাহারা নাবালক ও নালায়েক পাঠকদের জন্য কোর্ট অফ ওয়ার্ডস খুলিবার কাজ করিতেছেন। কিন্তু, সমালোচক যত বড়ো বিচক্ষণ হােন-না কেন চিরকালই তাহারা পাঠকদের কোলে তুলিয়া সামলাইবেন, সেটা তো ধাত্রী এবং ধৃত কাহারও পক্ষে ভালো নয়। পাঠকদিগকে স্পষ্ট করিয়া সমজাইয়া দেওয়া উচিত কোনটা বস্তু এবং কোনটা বস্তু নয় । মুশকিল। এই যে, বস্তু একটা নহে এবং সব জায়গায় আমরা একই বস্তুর তত্ত্ব করি না। মানুষের বহুধা প্রকৃতি, তাহার আয়োজন নানা এবং বিচিত্র বস্তুর সন্ধানে তাহাকে ফিরিতে হয় । এখন কথা এই সাহিত্যের মধ্যে কোন বস্তুকে আমরা খুজি । ওস্তাদেরা বলিয়া থাকেন, সেটা রসবন্তু । বলা বাহুল্য, এখানে রাসসাহিত্যের কথাই হইতেছে। এই রাসটা এমন জিনিস যাহার বাস্তবতা