পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৪৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে। 3NOS পায় । সেই অবচ্ছিন্ন সত্য বিজ্ঞানের সত্য হইতে পারে, কিন্তু তাহা কবির সত্যও নহে, কবিগুরুর उनउठNG क्री । অন্য কবির কথা রাখিয়া দাও, তুমি নিজের হইয়া বলে । আচ্ছা, ভালো । তোমাদের নালিশ এই যে, খেলা, ছুটি, আনন্দ, এই সব কথা আমার কাব্যে বার বার আসিয়া পড়িতেছে। কথাটা যদি ঠিক হয় তবে বুঝিতে হইবে, একটা কোনো সত্যে আমাকে পাইয়াছে । তার হােত আমার আর এড়াইবার জো নাই । অতএব, এখন হইতে আমি বিধাতার মতোই বেহায়া হইয়া এক কথা হাজার বার বলিব । যদি আমাকে বানাইয়া বলিতে হইত। তবে ফি বারে নূতন কথা না বলিলে লিজা হইত । কিন্তু, সত্যের লজ্জা নাই, ভয় নাই, ভাবনা নাই । সে নিজেকেই প্ৰকাশ করে ; নিজেকেই প্ৰকাশ করা ছাড়া তার আর গতি নাই, এইজন্যই সে বেপরোয়া । এটা যেন তোমার অহংকারের মতো শোনাইতেছে । সত্যের দোহাই দিয়া নিন্দা করিলে যদি দোষ না হয়, তবে সত্যের দোহাই দিয়া অহংকার করিলেও দোষ নাই । অতএব, এখানে তোমাতে আমাতে শোধবোধ হইল । বাজে কথা আসিল । যে কথা লইয়া তর্ক হইতেছিল সেটাসেটা এই যে, জগতে শক্তির লড়াইটাকেই প্ৰধান করিয়া দেখা অবচ্ছিন্ন দেখা- অর্থাৎ গানকে বাদ দিয়া সুরের কসরতকে দেখা । আনন্দকে দেখাই সম্পূর্ণকে দেখা । এ কথা আমাদেরই দেশের সব চেয়ে বড়ো কথা । উপনিষদের চরম কথাটি এই যে, আনন্দাদ্ধোব খঘিমানি ভুতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং সম্প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি । আনন্দ হতেই সমস্ত উৎপন্ন হয়, সমস্ত বঁাচে, আনন্দের দিকেই সমস্ত চলে । এই যদি উপনিষদের চরম কথা হয় তবে কি ঋষি বলিতে চান, জগতে পাপ নাই, দুঃখ নাই, রেষারেষি নাই ? আমরা তো ঐগুলোর উপরেই বেশি করিয়া জোর দিতে চাই ; নাহিলে মানুষের চেতনা হইবে কেমন করিয়া । উপনিষৎ ইহার উত্তর দিয়াছেন, কোহ্যেবান্যাৎ কঃ প্ৰাণ্যাৎ যাদেষ আকাশ আনন্দো ন স্যাৎ । কেইবা শরীরের চেষ্টা প্ৰাণের চেষ্টা করিতি- অর্থাৎ, কেইবা দুঃখীধন্দা লেশমাত্র স্বীকার করিতআনন্দ যদি আকাশ ভরিয়া না থাকিত । অর্থাৎ, আনন্দই শেষ কথা বলিয়াই জগৎ দুঃখদ্বন্দ্ব সহিতে পারে। শুধু তাই নয়, দুঃখের পরিমাপেই আনন্দের পরিমাপ। আমরা প্রেমকে ততখানিই সত্য জানি যতখানি সে দুঃখ বহন করে। অতএব, দুঃখ তো আছেই। কিন্তু তাহার উপরে আনন্দ আছে বলিয়াই সে আছে। নহিলে কিছুই থাকিত না, হানাহানি মারামারিও না । তোমরা যখন দুঃখকেই স্বীকার কর তখন আনন্দকে বাদ দাও, কিন্তু আনন্দকে স্বীকার করিলে, দুঃখকে বাদ দেওয়া হয় না । অতএব, তোমরা যখন বল, হানাহানি করিতে করিতে যাহা টিকিল তাঁহাই সৃষ্টি, সেটা একটা অবচ্ছিন্ন, কথা, ইংরেজিতে যাকে বলে অ্যাবস্ট্রাকসন- আর আনন্দ হইতেই সমস্ত হইতেছে ও টিকিতেছে, এইটেই হইল পুরা সত্য । আচ্ছা, তোমার কথাই মানিয়া লইলাম, কিন্তু এটা তো একটা তত্ত্বজ্ঞানের কথা। সংসারের কাজে ইহার দাম কী । সে জবাবদিহি কবির নয়, এমন-কি, বৈজ্ঞানিকেরও নয় । কিন্তু, যেরকম দিনকাল পড়িয়াছে কবিদের মতো সংসারের নেহাত অনাবশ্যক লোকেরও হিসাবনিকাশের দায় এড়াইয়া চলিবার জো নাই। আমাদের দেশের অলংকারশাস্ত্রে রসকে চিরদিন অহেতুক অনির্বচনীয় বলিয়া আসিয়াছে, সুতরাং যারা রসের কারবারী তাহাদিগকে এ দেশে প্রয়োজনের হাটের মাসুল দিতে হয় নাই। কিন্তু, শুনিতে পাই, পশ্চিমের কোনো কোনো নামজাদা পাকা লোক রসকে কাব্যের চরম পদাৰ্থ বলিয়া মানিতে রাজি নন, রসের তলায় কোনো তলানি পড়ে কি না সেইটো দেখিয়া নিক্তিতে মাপিয়া তারা কাব্যের দাম ঠিক করিতে চান । সুতরাং, কোনো কথাতেই অনির্বাচনীয়তার দোহাই দিতে গেলে আজকাল আমাদের দেশেও লোকে সেকেলে এবং ওরিয়েন্টাল বলিয়া নিন্দ করিতে পারে । সে নিন্দা