পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫২

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

3\98 রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী সাহিত্য উপনিষদ ব্ৰহ্মস্বরূপের তিনটি ভাগ করেছেন- সত্যম, জ্ঞানম, এবং অনন্তম । চিরন্তনের এই তিনটি স্বরূপকে আশ্রয় ক’রে মানব-আত্মারও নিশ্চয় তিনটি রূপ আছে । তার একটি হল, আমরা আছি ; আর-একটি, আমরা জানি ; আর-একটি কথা তার সঙ্গে আছে তাই নিয়েই আজকের সভায় আমার আলোচনা । সেটি হচ্ছে, আমরা ব্যক্ত করি। ইংরেজিতে বলতে গেলে বলা যায়— I am. I know, I express, মানুষের এই তিন দিক এবং তিন নিয়েই একটি অখণ্ড সত্য ! সত্যের এই তিন ভাব আমাদের নানা কাজে ও প্রবর্তনায় নিয়ত উদ্যত করে । টিকতে হবে তাই অন্ন চাই, বস্ত্ৰ চাই, বাসস্থান চাই, স্বাস্থ্য চাই । এই নিয়ে তার নানা রকমের সংগ্রহ রক্ষণ ও গঠনকার্য। “আমি আছিা সত্যের এই ভাবটি তাকে নানা কাজ করায় । এই সঙ্গে আছে। “আমি জানি । এরও তাগিদ কম নয় । মানুষের জানার আয়োজন অতি বিপুল, আর তা কেবলই বেড়ে চলেছে, তার মূল্য মানুষের কাছে খুব বড়ো । এই সঙ্গে মানবসত্যের আর-একটি দিক আছে। “আমি প্ৰকাশ করি।” । “আমি আছি' এইটি হচ্ছে ব্ৰহ্মের সত্য-স্বরূপের অন্তর্গত ; “আমি জানি’ এটি ব্ৰহ্মের জ্ঞানস্বরাপের অন্তর্গত ; “আমি প্ৰকাশ করি।” এটি ব্ৰহ্মের অনন্তস্বরূপের অন্তর্গত । ‘আমি আছি। এই সত্যকে রক্ষা করাও যেমন মানুষের আত্মরক্ষা, তেমনি “আমি জানি এই সত্যকে রক্ষা করাও মানুষের আত্মরক্ষা- কেননা, মানুষের স্বরূপ হচ্ছে জ্ঞানস্বরূপ । অতএব, মানুষ যে কেবলমাত্র জানবে কী দিয়ে, কী খাওয়ার দ্বারা আমাদের পুষ্টি হয়, তা নয় । তাকে নিজের জ্ঞানস্বরূপের গরজে রাত্রির পর রাত্রি জিজ্ঞাসা করতে হবে, মঙ্গলগ্ৰহে যে-চিহ্নজাল দেখা যায় সেটা কী । জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে হয়তো তাতে তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা অত্যন্ত পীড়িত হয় । অতএব, মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে তার জ্ঞানময় প্রকৃতির সঙ্গে সংগত ক’রে জানাই ঠিক জানা, তার প্রাণময় প্রকৃতির সঙ্গে একান্ত যুক্ত করে জানা ঠিক জানা নয় । আমি আছি, আমাকে টিকে থাকতে হবে, এই কথাটি যখন সংকীর্ণ সীমায় থাকে, তখন আত্মরক্ষা বংশরক্ষা কেবল আমাদের অহংকে আঁকড়ে থাকে । কিন্তু, যে পরিমাণে মানুষ বলে যে, অন্যের টিকে থাকার মধ্যেই আমার টিকে থাকা, সেই পরিমাণে সে নিজের জীবনের মধ্যে অনন্তের পরিচয় দেয় ; সেই পরিমাণে “আমি আছি' এবং ‘অন্য সকলে আছে। এই ব্যবধানটা তার ঘুচে যায়। এই অন্যের সঙ্গে ঐক্যবোধের দ্বারা যে মাহাত্ম্য ঘটে। সেইটেই হচ্ছে আত্মার ঐশ্বর্য ; সেই মিলনের প্রেরণায় মানুষ নিজেকে নানা প্রকারে প্রকাশ করতে থাকে । যেখানে একলা মানুষ সেখানে তার প্রকাশ নেই। টিকে থাকার অসীমতা-বোধকে অর্থাৎ “আপনার থাকা অন্যের থাকার মধ্যে এই অনুভূতিকে মানুষ নিজেরই ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র দৈনিক ব্যবহারের মধ্যে প্রচ্ছন্ন রাখতে পারে না । তখন সেই মহাজীবনের প্রয়োজনসাধনের উদ্দেশ্যে নানা প্রকার সেবায় ত্যাগে সে প্রবৃত্ত হয়, এবং সেই মহাজীবনের আনন্দকে আবেগকে সে নানা সাহিত্যে স্থাপত্যে মূর্তিতে চিত্রে গানে প্রকাশ করতে থাকে । পূর্বে বলেছি, কেবলমাত্র নিজে নিজে একান্ত টিকে থাকবার ব্যাপারেও জ্ঞানের প্রয়োজন আছে। কিন্তু, সে জ্ঞানের দীপ্তি নেই। জ্ঞানের রাজ্যে যেখানে অসীমের প্রেরণা সেখানে মানুষের শিক্ষার কত উদ্যোগ, কত পাঠশালা, কত বিশ্ববিদ্যালয়, কত বীক্ষণ, কত পরীক্ষণ, কত আবিষ্কার, কত উদ্ভাবনা । সেখানে মানুষের জ্ঞান সর্বজনীন ও সর্বকালীন হয়ে মানবাত্মার সর্বত্র প্রবেশের অধিকারকে ঘোষণা করে । এই অধিকারের বিচিত্র আয়োজন বিজ্ঞানে দর্শনে বিস্তৃত হতে থাকে। কিন্তু, তার বিশুদ্ধ আনন্দরসটি নানা রচনায় সাহিত্যে ও আর্টে প্ৰকাশ পায় । তবেই একটা কথা দেখছি যে, পশুদের মতো মানুষেরও যেমন নিজে টিকে থাকবার ইচ্ছা প্ৰবল, পশুদের মতো মানুষেরও যেমন প্রয়োজনীয় জ্ঞানের কৌতুহল সর্বদা, সচেষ্ট, তেমনি মানুষের আর-একটি জিনিস আছে যা পশুদের নেই- সে ক্রমাগতই তাকে কেবলমাত্র প্রাণধারণের সীমার বাইরে নিয়ে যায় । এইখানেই আছে প্ৰকাশিতত্ত্ব ।