পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 VV झील-द्रष्कादी শাস্ত্রী পাহারা দিয়ে তার অন্তঃপুরের হংসপদিকদের মহলে আটকে রাখতে পারে নি। পণ্ডিতরা লড়াই করতে থাকুন, তা খৃস্টজন্মের পাঁচশো বছর পূর্বে কি পরে রচিত । তার গায়ে সকল তারিখেরই ছাপ আছে । পণ্ডিতেরা তর্ক করতে থাকুন, তা শিপ্রাতীরে রচিত হয়েছিল না গঙ্গাতীরে । তার মন্দাক্রান্তার মধ্যে পূর্ববাহিনী পশ্চিমবাহিনী সকল নদীরই কলধ্বনি মুখরিত। অপর পক্ষে এমন-সব পাচলি আছে যার অনুপ্রাসছটার চকমকি ঠোকা স্মৃফুলিঙ্গবর্ষণে সভাস্থ হাজার হাজার লোকে মুগ্ধ হয়ে গেছে ; তাদের বিশুদ্ধ স্বাদেশিকতায় আমরা যতই উত্তেজিত হই-না কেন, সে-সব পাচলির দেশ ও কাল সুনির্দিষ্ট ; কিন্তু সর্বদেশ ও সর্বকাল তাদের বর্জন করাতে তারা কুলীনের অনুঢ়া মেয়ের মতো ব্যর্থ কুলগৌরবকে কলাগাছের কাছে সমাপণ ক’রে নিঃসন্ততি হয়ে চলে যাবে । উপনিষদ যেখানে ব্রহ্মের স্বরূপের কথা বলেছেন অনন্তম, সেখানে তার প্রকাশের কথা কী বলেছেন । বলেছেন, আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি । এইটে হল আমাদের আসল কথা । সংসারটা যদি গারুদখানা হত তা হলে সকল সিপাই মিলে রাজদণ্ডের ঠেলা মেরেও আমাদের টলাতে পারত না । আমরা হরতাল নিয়ে বসে থাকতেম, বলতেম “আমাদের পানাহার বন্ধ । কিন্তু, আমি তো স্পষ্টই দেখছি, কেবল যে চারি দিকে তাগিদ আছে তা নয় । বারে বারে আমার হৃদয় যে মুগ্ধ হয়েছে। এর কী দরকার ছিল । টিটাগড়ের পাটকলের কারখানায় যে মজুরেরা খেটে মরে তারা মজুরি পায়, কিন্তু তাদের হৃদয়ের জন্যে তো কারও মাথাব্যথা নেই । তাতে তো কল বেশ ভালোই চলে । যে মালিকেরা শতকরা ৪০০ টাকা হারে মুনাফা নিয়ে থাকে তারা তো মনোহরণের জন্য এক পয়সাও অপব্যয় করে না । কিন্তু, জগতে তো দেখছি, সেই মনোহরণের আয়োজনের অন্ত নেই। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, এ কেবল বোপদেবের মুগ্ধবোধের সূত্ৰজাল নয়, এ যে দেখি কাব্য । অর্থাৎ, দেখছি ব্যাকরণটা রয়েছে দাসীর মতো পিছনে, আর রসের লক্ষ্মী রয়েছেন সামনেই । তা হলে কি এর প্রকাশের মধ্যে দণ্ডীর দণ্ডই রয়েছে না রয়েছে কবির আনন্দ ? এই-যে সূর্যোদয় সূর্যস্ত, এই-যে আকাশ থেকে ধারণী পর্যন্ত সৌন্দর্যের প্লাবন, এর মধ্যে তো কোনো জবরদস্ত পাহারাওয়ালার তকমার চিহ্ন দেখতে পাই নে। ক্ষুধার মধ্যে একটা তাগিদ আছে বটে, কিন্তু ওটা তো স্পষ্টই একটা ‘না’ এর ছাপ-মারা জিনিস । 'ই' আছে বটে ক্ষুধা-মেটাবার সেই ফলটির মধ্যে, রসনা যাকে সরস আগ্রহের সঙ্গে আত্মীয় বলে অভ্যর্থনা করে নেয় । তা হলে কোনটাকে সামনে দেখব। আর কোনটাকে পিছনে ? ব্যাকরণটাকে না কাব্যটিকে ? পাকশালকে না ভোজের নিমন্ত্রণকে ? গৃহকর্তার উদ্দেশ্যটি কোনখানে প্ৰকাশ পায়- যেখানে, নিমন্ত্রণপত্ৰ হাতে, ছাতা মাথায় হেঁটে এলেম না যেখানে আমার আসন পাতা হয়েছে ? সৃষ্টি আর সর্জন হল একই কথা । তিনি আপনাকে পরিপূর্ণভাবে বিসর্জন করেছেন, বিলিয়ে দিয়েছেন ব’লেই আমাদের প্রাণ জুড়িয়ে দিয়েছেন- তাই আমাদের হৃদয় বলে 'আঃ' বঁাচলেম” ৷ শুক্ল সন্ধ্যার আকাশ জ্যোৎস্নায় উপছে পড়েছে- যখন কমিটি-মিটিঙে। তর্ক বিতর্ক চলেছে তখন সেই আশ্চর্য খবরটি ভুলে থাকতে পারি, কিন্তু তার পর যখন দশটা রাত্রে ময়দানের সামনে দিয়ে বাড়ি ফিরি। তখন ঘন চিন্তার ফাকের মধ্যে দিয়ে যে প্রকাশটি আমার মনের প্রাঙ্গণে এসে দাড়ায় তাকে দেখে আর কী বলব। বলি, আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি । সেই যে যৎ আনন্দরূপে যার প্রকাশ, সে কোন পদাৰ্থ । সে কি শক্তি-পদাৰ্থ । রান্নাঘরে শক্তির প্রকাশ' লুকিয়ে আছে । কিন্তু, ভোজের থালায় সে কি শক্তির প্রকাশ । মোগলসম্রাট প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন শক্তিকে । সেই বিপুল কাঠখড়ের প্রকাশকে কি প্ৰকাশ বলে । তার মূর্তি কোথায় । আওরঙজেবের নানা আধুনিক অবতাররাও রক্তরেখায় শক্তিকে প্রকাশ করবার জন্যে অতি বিপুল আয়োজন করেছেন । কিন্তু যিনি আবিঃ, যিনি প্রকাশস্বরূপ, আনন্দরূপে যিনি ব্যক্ত হচ্ছেন, তিনি সেই রক্তরেখার উপরে রবার বুলোতে এখনি শুরু করেছেন । আর, তার আলোকরশ্মির সম্মার্জনী তাদের আয়োজনের আবর্জনার উপর নিশ্চয় পড়তে আরম্ভ হয়েছে। কেননা, তার আনন্দ যে প্ৰকাশ, আর আনন্দই যে তার প্রকাশ ।