পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৫

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8w©ዒ এই প্ৰকাশটিকে আচ্ছন্ন করে তার শক্তিকে যদি তিনি সামনে রাখতেন তা হলে তঁকে মানার মতো অপমান আমার পক্ষে আর কিছু হতে পারে না । যখন জাপানে যাচ্ছিলাম জাহাজ পড়ল দারুণ ঝড়ে । আমি ছিলেম ডেকে বসে । আমাকে ডুবিয়ে মারার পক্ষে পবনের একটা ছোটো নিশ্বাসই যথেষ্ট ; কিন্তু কালো সাগরের বুকের উপর পাগলা ঝড়ের যে-নৃত্য তার আয়োজন হচ্ছে আমার ভিতরে যে পাগল মন আছে তাকে মাতিয়ে তোলবার জন্যে । ঐ বিপুল সমারোহের দ্বারাই পাগলের সঙ্গে পাগলের মোকাবিলায় রহস্যালাপ হতে পারল । নাহয় ডুবেই মরতেম- সেটা কি এর চেয়ে বড়ো কথা । রুদ্রবীণার ওস্তাদজি তার - এই রুদ্রবীণার শাগরেদকে ফেনিল তরঙ্গ-তাণ্ডবের মধ্যে দুটাে-একটা চক্র-হাওয়ার দ্রুত-তালের তান শুনিয়ে দিলেন । সেইখানে বলতে পারলেম, “তুমি আমার আপনার ।” অমৃতের দুটি অর্থ— একটি যার মৃত্যু নেই, এবং যা পরম রস । আনন্দ যে রূপ ধরেছে এই তো হল রস । অমৃতও যদি সেই রাসই হয় তবে রসের কথা পুনরুক্ত হয় মাত্র । কাজেই এখানে বলব অমৃত মানে যা মৃত্যুহীন- অর্থাৎ আনন্দ যেখানে রূপ ধরেছে সেইখানেই সেই প্ৰকাশ মৃত্যুকে অতিক্রম করেছে । সবাই দেখাচ্ছে কালের ভয় । কালের রাজত্বে থেকেও কালের সঙ্গে যার অসহযোগ সে কোথায় | এইবারে আমাদের কথা । কাব্য যেটি ছন্দে গাথা হয়, রূপদক্ষ যে-রািপ রচনা করেন, সেটি যদি আনন্দের প্রকাশ হয় তবে সে মৃত্যুজয়ী ।- এই রূপদক্ষ’ কথাটি আমার নূতন পাওয়া । ইনসক্রিপশন অর্থাৎ একটা প্ৰাচীনলিপিতে পাওয়া গেছে, আটিস্টের একটা চমৎকার প্রতিশব্দ - কাব্যের বা চিত্রের তো সমাপ্তিতে সমাপ্তি নেই । মেঘদূত শোনা হয়ে গেল, ছবি দেখে বাড়ি ফিরে এলেম, কিন্তু মনের মধ্যে একটা অবসাদকে তো নিয়ে এলেম না । গান যখন সমে এসে থামল তখন ভারি। আনন্দে মাথা বঁকা দিলেম । সম মানে তো থামা, তাতে আনন্দ কেন- তার কারণ হচ্ছে, আনন্দরূপ থামাতে থামে না । কিন্তু, টাকাটা যেই ফুরিয়ে গেল তখন তো সমে মাথা নেড়ে বলি নে— “আঃ' । গান থামল- তবু সে শূন্যের মতো অন্ধকারের মতো থামল না কেন । তার কারণ, গানের মধ্যে একটি তত্ত্ব আছে যা সমগ্ৰ বিশ্বের আত্মার মধ্যে আছে- কাজেই সে সেই ‘ও’কে আশ্রয় করে থেকে যায় ; তার জন্যে কোনো গর্ত কোথাও নেই । এই গান আমি শুনি বা নাই শুনি, তাকে প্ৰত্যক্ষত কেউ নিল বা নাই নিল, তাতে কিছুই আসে-যায় না । কত অমূল্যধন চিত্রে কাব্যে হারিয়ে গেছে কিন্তু সেটা একটা বাহ্য ঘটনা, একটা আকস্মিক ব্যাপার । আসল কথা হচ্ছে এই যে, তারা আনন্দের ঐশ্বর্যকে প্ৰকাশ করেছে, প্রয়োজনের দৈন্যকে করে নি । সেই দৈন্যের রূপটা যদি দেখতে চাও তবে পাটকলের কারখানায় গিয়ে ঢোকো যেখানে গরিব চাষার রক্তকে ঘূণীচাকার পাক দিয়ে বহুশতকরা হারের মূনাফায় পরিণত করা হচ্ছে । গঙ্গাতীরের বাটচ্ছায়াসমাশ্রিত যে দেউলটিকে লোপ ক’রে দিয়ে ঐ প্ৰকাণ্ড-হা-করা কারখানা কালো ধোয়া উদগীৰ্ণ করছে সেই লুপ্ত দেউলের চেয়েও ঐ কারখানা-ঘর মিথ্যা । কেননা, আনন্দলোকে ওর স্থান নেই । বসন্তে ফুলের মুকুল রাশি রাশি ঝরে যায় ; ভয় নেই, কেননা ক্ষয় নেই । বসন্তের ডালিতে অমৃতমন্ত্র আছে। রূপের নৈবেদ্য ভরে ভরে ওঠে । সৃষ্টির প্রথম যুগে যে-সব ভূমিকম্পের মহিষ তার শিঙের আক্ষেপে ভূতল থেকে তপ্তপঙ্ক উৎক্ষিপ্ত করে দিচ্ছিল তারা আর ফিরে এল না ; যে-সব অগ্নিনাগিণী রসাতলের আবরণ ফুড়ে ক্ষণে ক্ষণে ফণা তুলে পৃথিবীর মেঘাচ্ছন্ন আকাশকে দংশন করতে উদ্যত হয়েছিল তারা কোন বাঁশি শুনে শান্ত হয়ে গেল। কিন্তু, কচি কচি শ্যামল ঘাসের কোমল চুম্বন আকাশের নীল চোখকে বারে বারে জুড়িয়ে দিচ্ছে। তারা দিনে দিনে ফিরে ফিরে আসে । আমার ঘরের দরজার কাছে কয়েকটি কাটােগাছে বসন্তের সোহাগে ফুল ফুটে ওঠে । সে হল কণ্টিকারীর ফুল । তার বেগুনি রঙের কোমল বুকের মাঝখানে একটুখানি হলদে সোনা । আকাশে তাকিয়ে যে-সূর্যের কিরণকে সে ধ্যান করে সেই ধ্যানটুকু তার বুকের মাঝখানটিতে যেন মধুর হয়ে রইল। এই ফুলের কি খ্যাতি আছে । আর, এ কি ঝরে ঝরে পড়ে না । কিন্তু, তাতে ক্ষতি হল কী । পৃথিবীর অতো