পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৫৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 88) গড়ন, কত রঙ দিয়ে আঁকা। একে সময় নষ্টা করা বললে প্রতিবাদ করা যায় না। রূপদক্ষ আপনার চিত্তকে এই একটি ঘটের উপর উজাড় ক’রে ঢেলে দিয়েছে ; বলতে পাের, সমস্তই বাজে খরচ হল । সে কথা মানি ; সৃষ্টির বাজে-খরচের বিভাগেই অসীমের খাস-তহবিল । ঐখানেই যত রঙের রঙ্গিমা, রূপের ভঙ্গি । যারা মুনফার হিসাব রাখে তারা বলে, এটা লোকসান ; যারা সন্ন্যাসী তারা বলে, এটা অসংযম | বিশ্বকৰ্মা তার হাপর হাতুড়ি নিয়ে ব্যস্ত, এর দিকে তাকান না । বিশ্বকবি এই বাজে-খরচের বিভাগে তার থলি বুলি কেবলই উজাড় ক’রে দিচ্ছেন, অথচ রসের ব্যাপার আজও দেউলে হল না । শরীরের পিপাসা ছাড়া আর-এক পিপাসাও মানুষের আছে। সংগীত চিত্ৰ সাহিত্য মানুষের হৃদয়ের সম্বন্ধে সেই পিপাসাকেই জানান দিচ্ছে । ভোলবার জো কী । সে যে অন্তরবাসী একের বেদনা । সে বলছে, “আমাকে বাহিরে প্রকাশ করো, রূপে রঙে সুরে বাণীতে নৃত্যে । যে যেমন করে পার আমার অব্যক্ত ব্যথাটিকে ব্যক্ত করে দাও৷ ” এই ব্যাকুল প্রার্থনা যার হৃদয়ের গভীরে এসে পৌচেছে সে আপিসের তাড়া, ব্যবসায়ের তাগিদ, হিতৈষীর কড়া হুকুম ঠেলে ফেলে দিয়ে বেরিয়ে পড়েছে। কিছু না, একখানি তাম্বুরা হাতে নিয়ে ঘর ছেড়ে বাইরে এসেছে। কী যে করবে কে জানে । সুরের পর সুর, রাগের পর রাগ যে তার অন্তরে বাজিয়ে তুলবে সে কে । সে তো বিজ্ঞানে যাকে প্রকৃতি বলে থাকে সেই প্ৰকৃতি নয়। প্রাকৃতিক নির্বাচনের জন্ম-খরচের খাতায় তার হিসাব মেলে না। প্রাকৃতিক নির্বাচন তার জঠরের মধ্যে হুকুম জহির করছে। কিন্তু, মানুষ কি পশু যে প্রাকৃতিক নির্বাচনের চাবুকের চোখে প্রকৃতির নির্দিষ্ট পথে চলবে । লীলাময় মানুষ প্রকৃতিকে ডেকে বললে, “আমি রসে ভোর, আমি তোমার তাবেদার নই, চাবুক লাগাও তোমার পশুদের পিঠে । আমি তো ধনী হতে চাই নে, আমি তো পালোয়ান হতে চাই নে, আমার মধ্যে সেই বেদনা আছে যা নিখিলের অন্তরে । আমি লীলামায়ের শরিক ।” এই কথাটি জানতে হবে- মানুষ কেন ছবি আঁকতে বসে, কেন গান করে । কখনো কখনো যখন আপন-মনে গান গেয়েছি তখন কীটসের মতোই আমাকেও একটা গভীর প্রশ্ন ব্যাকুল করে তুলেছে, জিজ্ঞাসা করেছি- এ কি একটা মায়ামাত্র না। এর কোনো অর্থ আছে। গানের সুরে নিজেকে ভাসিয়ে দিলেম, আর সব জিনিসের মূল্য যেন এক মুহুর্তে বদলে গেল। যা অকিঞ্চিৎকর ছিল তাও অপরূপ হয়ে উঠল । কেন । কেননা, গানের সুরের আলোয় এতক্ষণে সত্যকে দেখলুম। অন্তরে সর্বদা এই গানের দৃষ্টি থাকে না বলেই সত্য তুচ্ছ হয়ে সরে যায়। সত্যের, ছোটাে বড়ো সকল, রূপই যে অনির্বচনীয় তা আমরা অনুভব করতে পারি নে। নিত্য-অভ্যাসের স্কুল পর্দায় তার দীপ্তিকে আবৃত করে দেয় । সুরের বাহন সেই পর্দার আড়ালে সত্যলোকে আমাদের নিয়ে যায় ; সেখানে পায়ে হেঁটে যাওয়া যায় না, সেখানে যাবার পথ কেউ চোখে দেখে নি । একটু বেশি কবিত্ব লাগছে ? শ্রোতারা মনে ভাবছেন, বাড়াবাড়ি হচ্ছে। একটু বুঝিয়ে বলবার চেষ্টা করা যাক । আমাদের মন যে জ্ঞানরাজ্যে বিচরণ করে সেটা দুইমুখো পদার্থ ; তার একটা দিক হচ্ছে তথ্য, আর-একটা দিক হচ্ছে সত্য । যেমনটি আছে তেমনটির ভাব হচ্ছে তথ্য ; সেই তথ্য অবলম্বন ক’রে থাকে সেই হচ্ছে সত্য । আমার ব্যক্তিরূপটি হচ্ছে আমাতে বদ্ধ আমি । এই-যে তথ্যটি এ অন্ধকারবাসী, এ আপনাকে আপনি প্রকাশ করতে পারে না। যখনই এর পরিচয় কেউ জিজ্ঞাসা করবে। তখনই একটি বড়ো সত্যের দ্বারা এর পরিচয় দিতে হবে, যে সত্যকে সে আশ্রয় করে আছে । বলতে হবে, আমি বাঙালি । কিন্তু, বাঙালি কী । ও তো একটা অবচ্ছিন্ন পদার্থ, ধরা যায় না, ছোওয়া যায় না । তা হোক, ঐ ব্যাপক সত্যের দ্বারাই তথ্যের পরিচয় । তথ্য খণ্ডিত, স্বতন্ত্র- সত্যের মধ্যে সে আপনি বৃহৎ ঐক্যকে প্ৰকাশ করে। আমি ব্যক্তিগত আমি এই তথ্যটুকুর মধ্যে, আমি মানুষ এই সত্যটিকে যখন আমি প্রকাশ করি তখনই বিরাট একের আলোকে আমি নিত্যতায় উদ্ভাসিত হই । তথ্যের মধ্যে সত্যের প্রকাশই হচ্ছে প্ৰকাশ । যেহেতু সাহিত্য ও ললিতকলার কাজই হচ্ছে প্ৰকাশ, এইজন্যে তথ্যের পাত্রকে আশ্রয় ক’রে