পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬০

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

88令 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমাদের মনকে সত্যের স্বাদ দেওয়াই তার প্রধান কাজ । এই স্বাদটি হচ্ছে একের স্বাদ, অসীমের স্বাদ । আমি ব্যক্তিগত আমি, এটা হল আমার সীমার দিকের কথা ; এখানে আমি ব্যাপক একের থেকে বিচ্ছিন্ন। আমি মানুষ, এটা হল আমার অসীমের অভিমুখী কথা ; এখানে আমি বিরাট একের সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রকাশমান । চিত্রী যখন ছবি আঁকতে বসেন তখন তিনি তথ্যের খবর দেবার কাজে বসেন না। তখন তিনি তথ্যকে ততটুকু মাত্র স্বীকার করেন যতটুকুর দ্বারা তাকে উপলক্ষ করে কোনো একটা সুষমার ছন্দ বিশুদ্ধ হয়ে দেখা দেয় । এই ছন্দটি বিশ্বের নিত্যবত্ত ; এই ছন্দের ঐক্যসূত্রেই তথ্যের মধ্যে আমরা সত্যের আনন্দ পাই । এই বিশ্বছন্দের দ্বারা উদ্ভাসিত না হলে; তথ্য আমাদের কাছে অকিঞ্চিৎকর । গোধূলিবেলায় একটি বালিকা মন্দির থেকে বাহির হয়ে এল, এই তথ্যটি মাত্র আমাদের আছে অতি সামান্য । এই সংবাদমাত্রের দ্বারা এই ছবিটি আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে না, আমরা শুনেও শুনি নে ; একটি চিরন্তন এক-রূপে এটি আমাদের চিত্তে স্থান পায় না । যদি কোনো নাছোড়বান্দা বক্তা আমাদের মনোযোগ জাগাবার জন্যে এই খবরটির পুনরাবৃত্তি করে, তা হলে আমি বিরক্ত হয়ে বলি, “না হয় বালিকা মন্দির থেকে বাহির হয়ে এল, তাতে আমার কী ।” অর্থাৎ, আমার সঙ্গে তার কোনো সম্বন্ধ অনুভব করি নে বলে এ ঘটনাটি আমার কাছে সত্যই নয় । কিন্তু, যে-মুহুর্তে ছন্দে সুরে উপমার যোগে এই সামান্য কথাটাই একটি সুষমার অখণ্ড ঐক্যে সম্পূর্ণ হয়ে দেখা দিল অমনি এ প্রশ্ন শান্ত হয়ে গেল যে, “তাতে আমার কী।' কারণ, সত্যের পূর্ণরূপ যখন আমরা দেখি তখন তার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্বন্ধের দ্বারা আকৃষ্ট হই নে, সত্যগত সম্বন্ধের দ্বারা আকৃষ্ট হই । গোধূলিবেলায় বালিকা মন্দির হতে বাহির হয়ে এল, এই কথাটিকে তথ্য হিসাবে যদি সম্পূর্ণ করতে হত তা হলে হয়তো আরো অনেক কথা বলতে হত ; আশপাশের অধিকাংশ খবরই বাদ গিয়েছে । কবি হয়তো বলতে পারতেন, সে সময়ে বালিকার খিদে পেয়েছিল এবং মনে মনে মিষ্টান্নবিশেষের কথা চিন্তা করছিল । হয়তো সেই সময়ে এই চিন্তাই বালিকার পক্ষে সকলের চেয়ে প্রবল ছিল। কিন্তু, তথ্যসংগ্ৰহ কবির কাজ নয়। এইজন্যে খুব বড়ো বড়ো কথাই ছাঁটা পড়েছে। সেই তথ্যের বাহুল্য বাদ পড়েছে বলেই সংগীতের বাধনের ছোটো কথাটি এমন একত্বে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে, কবিতাটি এমন সম্পূর্ণ অখণ্ড হয়ে জেগেছে, পাঠকের মন এই সামান্য তথ্যের ভিতরকার সত্যকে এমন গভীরভাবে অনুভব করতে পেরেছে। এই সত্যের ঐক্যকে অনুভব করবামাত্র আমরা আনন্দ পাই । যথাথ গুণী যখন একটা ঘোড়া আঁকেন তখন বর্ণ ও রেখা সংস্থানের দ্বারা একটি সুষমা উদ্ভাবন ক’রে সেই ঘোড়াটিকে একটি সত্যরূপে আমাদের কাছে পৌঁছিয়ে দেন, তথ্যরূপে নয়। তার থেকে সমস্ত বাজে খুঁটিনাটির বিক্ষিপ্ততা বাদ পড়ে যায়, একখানা ছবি আপনার নিরতিশয় ঐক্যটিকে প্ৰকাশ করে । তথ্যগত ঘোড়ার বহুল আত্মত্যাগের দ্বারা। তবে এই ঐক্যটি বাধামুক্ত বিশুদ্ধরূপে ব্যক্ত হয় । কিন্তু, তথ্যের সুবিধা এই যে, তার পরীক্ষা সহজ । ঘোড়ার ছবি যে ঠিক ঘোড়ার মতোই হয়েছে তা প্ৰমাণ করতে দেরি লাগে না । ঘোর অরসিক ঘোড়ার কানের ডগা থেকে আরম্ভ করে তার লেজের শেষ পর্যন্ত হিসাব করে মিলিয়ে দেখতে পারে। হিসাবে ক্ৰটি হলে গভীর ভাবে মাথা নেড়ে মার্কা কেটে দেয়। ছবিতে ঘোড়াকে যদি ঘোড়ামাত্রই দেখানো হয় তা হলে পুরাপুরি হিসাব মেলে। আর, ঘোড়া যদি উপলক্ষ হয়। আর ছবিই যদি লক্ষ্য হয় তা হলে হিসাবের খাতা বন্ধ করতে হয় । বৈজ্ঞানিক যখন ঘোড়ার পরিচয় দিতে চান তখন তাকে একটা শ্রেণীগত সত্যের আশ্রয় নিতে হয় । এই ঘোড়াটি কী। না, একটি বিশেষ শ্রেণীভুক্ত স্তন্যপায়ী চতুষ্পদ। এইরকম ব্যাপক ভূমিকার মেধ্য না আনলে পরিচয় দেবার কোনো উপায় নেই । সাহিত্যে ও আর্টেও একটি ব্যাপক ভূমিকা আছে। সাহিত্যে ও আর্টে কোনো বস্তু যে সত্য তার "প্রমাণ হয় রসের ভূমিকায়। অর্থাৎ, সে বস্তু যদি এমন একটি রূপরেখাগীতের সুষমাযুক্ত ঐক্য লাভ করে যাতে করে আমাদের চিত্ত আনন্দের মূল্যে তাকে সত্য বলে স্বীকার করে, তা হলেই তার পরিচয় সম্পূর্ণ হয়। তা যদি না হয়। অথচ যদি তথ্য হিসাবে সে বস্তু একেবারে নিখুঁত হয়, তা হলে অরসিক