পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৩

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 386 সৃষ্টি আজ এই বক্তৃতাসভায় আসব বলে যখন প্ৰস্তুত হচ্ছি তখন শুনতে পেলুম, আমাদের পাড়ার গলিতে সানাই বাজছে। কী জানি কোন বাড়িতে বিবাহ। খাম্বাজের করুণ তান শহরের আকাশে আঁচল বিছিয়ে দিল । ... '" উৎসবের দিনে বাঁশি কেন বাজে । সে কেবল সুরের লেপ দিয়ে প্রত্যহের সমস্ত ভাঙাচোরা মলিনতা নিকিয়ে দিতে চায় । যেন আপিসের প্রয়োজনে লীেহপথে কুশ্ৰীতার রথযাত্রা চলছে না, যেন দরাদাম কেনাবেচা ও-সমস্ত কিছুই না। সব ঢেকে দিলে। ঢেকে দিলে কথাটা ঠিক হল না ; পর্দাটা তুলে দিলে- এই ট্রাম-চলাচলের, কেনা-বেচার, হাক-ডাকের পর্দা । বরবধূকে নিয়ে গেল নিত্যকালের অন্তঃপুরে, রসলোকে । তুচ্ছতার সংসারে, কেনাবেচার জগতে, বরবধুরাও তুচ্ছ ; কেই-বা জানে তাদের নাম, কেই-বা তাদের আসন ছেড়ে দেয় । কিন্তু, রসের নিত্যলোকে তারা রাজারানী । চারিদিকের ছোটো বড়ো সমস্ত থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে কিংখাবের সিংহাসনে তাদের বরণ করে দিতে হবে। প্রতিদিন তারা তুচ্ছতার অভিনয় করে, এইজন্যেই প্ৰতিদিন তারা ছায়ার মতো অকিঞ্চিৎকর । আজ তারা সত্যরাপে প্ৰকাশমান ; তাদের মূল্যের সীমা নেই ; তাদের জন্যে দীপমালা সাজানো, ফুলের ডালি প্ৰস্তুত, বেদমন্ত্রে চিরন্তন কাল তাদের আশীর্বাদ করবার জন্যে উপস্থিত । kų এই বরবধূ, এই দুটি মানুষ যে সত্য, কোনো রাজা-মহারাজার চেয়ে কম সত্য নয়, সমস্ত সংসার তাদের এই পরিচয়টি গোপন করে রাখে । কিন্তু, সেই নিত্যপরিচয় প্ৰকাশ করবার ভার নিয়েছে বঁাশি । মনে করো-না কেন, এককালে তপোবনে থাকত একটি মেয়ে ; সেদিনকার হাজার হাজার মেয়ের মধ্যে সেও ছিল সামান্যতার কুহেলিকায় ঢাকা । তাকে দেখে একদিন রাজার মন ভুলেছিল, আর-একদিন রাজা তাকে ত্যাগ করেছিল । সেদিন এমন কত ঘটেছে তার খবর কে রাখে । তাই তো রাজা নিজেকে লক্ষ্য করে বলেছে, “সকৃৎকৃতপ্ৰণয়োহয়ং জনঃ ” রাজার সকৃৎপ্ৰণয়ের প্রাত্যহিক উচ্ছিষ্টদের লক্ষ্য করে দেখবার, মনে ক’রে রাখবার, এত সময় আছে কার । কাজকর্ম তো থেমে থাকে না, কেনাবেচা তো চলছেই, হাটের মধ্যে যে ঠেলা ঠেলি ভিড় । সেই সংসারের পথে হংসপদিকদের পদচিহ্ন কোথাও পড়ে না, তাদের ঠেলে সরিয়ে ফেলে জীবনযাত্রার অসংখ্য যাত্রী ব্যন্ত হয়ে চলে যায়। কিন্তু, একটি তপোবনের বালিকাকে অসংখ্যের তুচ্ছলোক থেকে একের সত্যলোকে সুস্পষ্ট ক’রে দাড় করালে কে । সেও একটি কবির বঁাশি । যে সত্য প্রতিদিন ট্রামের ঘর্ঘরধবনি ও দরদামের হট্টগোলের মধ্যে চাপা পড়ে থাকে, খাম্বাজের করুণ রাগিণী আমাদের গলির মোড়ে সেই সত্যকে উদ্ধার করবার জন্যে সুরের অমৃত বর্ষণ করছে। তথ্যের সংকীর্ণতার থেকে মানুষ যেমনি সত্যের অসীমতায় প্রবেশ করে অমনি তার মূল্যের কত পরিবর্তন হয়, সে কি আমরা দেখি নে। রাখাল যখন ব্রজের রাখাল হয়ে দেখা দেয় তখন কি মথুরার রাজপুত্র বলে তার মূল্য । তখন কি তার পাচনির মহিমা৷ গদাচক্রের চেয়ে কম । তার বঁাশি কি পাঞ্চজন্যের কাছে লজ্জা পায়। সত্য যে সে কি মণিমালা ফেলে দিয়ে বনফুলের মালা পরতে কুষ্ঠিত । সেই রাখালবেশের সত্যকে প্রকাশ করতে পারে কে । সে তো কবির বাশি । রাজাধিরাজ মহারাজ নিজের মহিমা প্ৰকাশ করবার জন্যে কী আয়োজনই না করলে। তবু আজ বাদে কাল সেই বিপুল আয়োজনের বোঝা নিয়ে ঝঞ্চাশেষের মেঘের মতো দিগন্তরালে সে যায় মিলিয়ে । কিন্তু, সাহিত্যের অমরাবতীতে কলার নিত্য-নিকেতনে একটি পথের ভিক্ষু যে অখণ্ড সত্যে বিরাজ করে সেই সত্যের ক্ষয় নেই। রোমিয়ো-জুলিয়েটকে যখন সাহিত্যভুবনে দেখি তখন কোনো মূঢ় জিজ্ঞাসা করে না, ব্যাঙ্কে তাদের কত টাকা জমা আছে, ষড়দর্শনে তাদের বুৎপত্তি কত দূর, এমন-কি, দেবদ্বিজে তারা ভক্তিমান কি না এবং নিত্য নিয়মিত সন্ধ্যাহিকে তাদের কী পরিমাণ নিষ্ঠা । তারা সত্য এইমাত্র তাদের মহিমা ; সাহিত্য সেই কথাই প্ৰমাণ করে । সেই সত্যে যদি তিলমাত্র ব্যত্যয় ঘটে, অথচ নায়ক নায়িকা দোহে