পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৭

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 88S মানুষের স্বাতন্ত্র্যকে হরণ ক’রে একজন শক্তিশালী হচ্ছে, যেখানে বহু লোকের ক্ষুধার অন্ন একজন লোকের ভোগবাহুল্যে পরিণত হচ্ছে, সেখানে মানুষের সত্যরূপ, শান্তিরূপ আপনি সুন্দর সৃষ্টির মধ্যে প্ৰকাশ পেল না । যে মানুষ লোভী চিরদিনই সে নির্লজ্জ ; যে লোক শক্তির অভিমানী, সত্যযুগেও নিখিলের সঙ্গে আপন অসামঞ্জস্য নিয়েই সে দম্ভ করেছে। কিন্তু সেকালে তার লজ্জাহীনতাকে, তার দম্ভকে তিরস্কৃত করবার লোক ছিল । মানুষ সেদিন লোভীকে, শক্তিশালীকে, এ কথা বলতে কুষ্ঠিত হয় নি‘পৃথিবীতে সুন্দরের বাণী এসেছে, তুমি তাতে বেসুর লাগিয়ে না ; জগতে আনন্দলক্ষ্মীর যে সিংহাসন সে যে শতদল পদ্ম, মত্ত করার মতো তাকে দলতে যেয়ো না ।” এই কথাই বলছে কবির কাব্য, চিত্রীর চিত্রকলা । আজ বিবাহের দিনে বঁাশি বলছে, বরবধূ, তোমরা যে সত্য এই কথাটাই অন্য সকল কথার চেয়ে বড়ো করে আপনাদের মধ্যে প্ৰকাশ করে । লাখ দু-লাখ টাকা ব্যাঙ্কে জমছে বলেই যে সত্য তা নয় ; যে-সত্যের বাণী আমি ঘোষণা করি সে-সত্য বিশ্বের ছন্দের ভিতর, চেক বইয়ের অঙ্কের মধ্যেই নয় । সে-সত্য পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরের অমৃত সম্বন্ধে— গৃহসজ্জার উপকরণে নয় । সেই হচ্ছে সম্পূর্ণের সত্য, একের সত্য ।” আজ আমি সাহিত্যের কারুকারিতা সম্বন্ধে, তার ছন্দতত্ত্ব, তার রচনারীতি সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করব মনে স্থির করেছিলুম। এমন সময় বাজল বঁাশি । ইন্দ্ৰদেব সুন্দরকে দিয়ে বলে পাঠালেন, ‘ব্যাখ্যা করেই "যে-সব কথা বলা যায়, আর তপস্যা করেই যে-সব সাধনায় সিদ্ধিলাভ হয় এমন-সব লোক-প্রচলিত কথাকে তুমি কি কবি হয়েও বিশ্বাস কর । ব্যাখ্যা বন্ধ ক'রে তপস্যা ভঙ্গ ক’রে যে ফল পাওয়া যায় সেই হল অখণ্ড । সে তৈরি-করা জিনিস নয়, সে আপনি ফলে-ওঠা জিনিস ।” ধর্মশাস্ত্ৰে বলে, ইন্দ্ৰদেব কঠোর সাধনার ফল নষ্ট করবার জন্যেই মধুরকে পাঠিয়ে দেন। আমি দেবতার এই ঈর্ষা, এই প্ৰবঞ্চনা বিশ্বাস করি নে। সিদ্ধির পরিপূর্ণ অখণ্ড মূর্তিটি যে কিরকম তাই দেখিয়ে দেবার জন্যেই ইন্দ্ৰ মধুরকে পাঠিয়ে দেন । বলেন, “এ জিনিস লড়াই ক’রে তৈরি করে তোলবার জিনিস নয় ; এ ক্ৰমে ক্ৰমে থাকে থাকে গড়ে ওঠে না । সত্য সুরে গানটিকে যদি সম্পূৰ্ণ ক’রে তুলতে চাও, তা হলে রাতদিন বঁও-কষাকষি ক'রে তা হবে না । তাম্বুরার এই খাটি মধ্যম-পঞ্চম সুরটিকে প্রত্যক্ষ গ্রহণ করো এবং অখণ্ড সম্পূর্ণতাটিকে অন্তরে লাভ করো, তা হলে সমগ্র গানের ঐক্যটি সত্য হবে।’ মেনকা উর্বশী এরা হল ঐ তথুরার মধ্যম-পঞ্চম সুর- পরিপূর্ণতার অখণ্ড প্রতিমা । সন্ন্যাসীকে মনে করিয়ে দেয় সিদ্ধির ফল জিনিসটা কী রকমের । স্বৰ্গকামী, তুমি স্বৰ্গ চাও ! তাই তোমার তপস্যা ! কিন্তু, স্বৰ্গ তো পরিশ্রম করে মিস্ত্রি দিয়ে তৈরি হয় নি। স্বৰ্গ যে সৃষ্টি । উর্বশীর ওষ্ঠ্যপ্রান্তে যে-হাসিটুকু লেগে আছে তার দিকে চেয়ে দেখো, স্বর্গের সহজ সুরটুকুর স্বাদ পাবে । তুমি মুক্তিকামী, মুক্তি চাও ! একটু একটু করে অস্তিত্বের জাল ছিড়ে ফেলাকে তো মুক্তি বলে না । মুক্তি তো বন্ধনহীন শূন্যতা নয়। মুক্তি যে সৃষ্টি । মেনকার কবরীতে যে-পারিজাত ফুলটি রয়েছে তার দিকে চেয়ে দেখো, মুক্তির পূর্ণরূপের মূর্তিটি দেখতে পাবে। বিধাতার রুদ্ধ আনন্দ ঐ পারিজাতের মধ্যে মুক্তি পেয়েছে- সেই অরূপ আনন্দ রূপের মধ্যে প্রকাশ লাভ করে সম্পূর্ণ হয়েছে। বুদ্ধদেব যখন বোধিদ্রুমের তলায় বসে কৃচ্ছসাধন করেছেন তখন তার পীড়িত চিত্ত বলেছে ‘হল না’, ‘পেলুম না । তার পাওয়ার পূর্ণরূপের প্রতিমা বাইরে দেখতে পেলেন কখন । যখন সুজাতা অন্ন এনে দিলে । সে কি কেবল দেহের অন্ন । তার মধ্যে যে ভক্তি ছিল, শ্ৰীতি ছিল, সেবা ছিল, সৌন্দৰ্য ছিল- সেই পায়স-অল্পের মধ্যেই অমৃত অতি সহজে প্রকাশ পেল। ইন্দ্ৰদেব কি সুজাতাকে পাঠান নি। সেই সুজাতার মধ্যেই কি অমরাবতীর সেই বাণী ছিল না যে, কৃচ্ছসাধনে মুক্তি নেই, মুক্তি আছে প্রেমে। সেই ভক্তহৃদয়ের অন্ন-উৎসর্গের মধ্যে মাতৃপ্ৰাণের যে-সত্য ছিল সেই সত্যটি থেকেই কি বুদ্ধ বলেন নি “এক পুত্রের প্রতি মাতার যে-প্ৰেম সেই অপরিমেয় প্রেমে সমান্ত বিশ্বকে আপন করে দেখাকেই বলে ব্ৰহ্মবিহার ? অর্থাৎ, মুক্তি শূন্যতায় নয়, পূর্ণতায় ; এই পূর্ণতাই সৃষ্টি করে, ধ্বংস করে R | n