পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৮

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8 GO রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী মানবাত্মার যে প্ৰেম অসীম আত্মার কাছে আপনাকে একান্ত নিবেদন করে দিয়েই আনন্দ পায়, তার চেয়ে আর কিছুই চায় না, যিশুখৃস্ট তারই সহজ স্বরূপটিকে বাহিরের মূর্তিতে কোথায় দেখেছিলেন । ইন্দ্ৰদেব আপন সৃষ্টি থেকে এই মূর্তিটিকে তার কাছে পাঠিয়েছিলেন । মার্থ আর ম্যারি দুজনে তার * সেবা করতে এসেছিল । মাৰ্থ ছিল কর্তব্যপরায়ণা, সেবার কঠোরতায় সে নিত্যনিয়ত ব্যস্ত । ম্যারি সেই ব্যস্ততার ভিতর দিয়ে আত্মনিবেদনের পূর্ণতাকে বহু প্ৰয়াসে প্রকাশ করে নি। সে আপনি বহুমূল্য গন্ধতৈল খুষ্টের পায়ে উজাড় করে ঢেলে দিলে। সকলে বলে উঠল, “এ যে অন্যায় অপব্যয়।” খৃস্ট বললেন, “না, না, ওকে নিবারণ কোরো না।” সৃষ্টিই কি অপব্যয় নয়। গানে কি কারও কোনো লাভ আছে। চিত্রকলায় কি অন্নবস্ত্রের অভাব দূর হয়। কিন্তু, রসসৃষ্টির ক্ষেত্রে মানুষ আপন পূর্ণতাকে উৎসর্গ ক’রে দিয়েই পূর্ণতার ঐশ্বর্য লাভ করে। সেই ঐশ্বর্য শুধু তার সাহিত্যে ললিতকলায় নয়, তার আত্মবিসর্জনের লীলাভূমি সমাজে নানা সৃষ্টিতেই প্রকাশ পায় । সেই সৃষ্টির মূল্য জীবনযাত্রার উপযোগিতায় নয়, মানবাত্মার পূর্ণস্বরাপের বিকাশে- তা অহৈতুক, তা আপনাতে আপনি পর্যাপ্ত । যিশুখৃস্ট ম্যারির চরম আত্মনিবেদনের সহজ রূপটি দেখলেন। তখন তিনি নিজের অন্তরের পূর্ণতাকেই বাহিরে দেখলেন। ম্যারি যেন তার আত্মার সৃষ্টিরূপেই তার সম্মুখে অপরাপ মাধুর্যে প্রকাশিত হল। এমনি করেই মানুষ আপন সৃষ্টিকাৰ্যে আপন পূর্ণতাকে দেখতে চাচ্ছে। কৃচ্ছসাধনে নয়, উপকরণসংগ্রহে নয় । তার আত্মার আনন্দ থেকে তাকে উদ্ভাবিত করতে হবে স্বৰ্গলোক- লক্ষপতির কোষাগার নয়, পৃথ্বীপতির জয়স্তম্ভ নয়। তাকে যেন লোভে না ভোলায়, দম্ভে অভিভূত না করে ; কেননা সে সংগ্ৰহকর্তা নয়, নির্মাণকর্তা নয়, সে সৃষ্টিকর্তা । ኸ፧ কার্তিক ১৩৩১ সাহিত্যধর্ম কোটালের পুত্র, সওদাগরের পুত্র, রাজপুত্র, এই তিনজনে বাহির হন রাজকন্যার সন্ধানে । বস্তুত রাজকন্যা বলে যে একটি সত্য আছে তিন রকমের বুদ্ধি তাকে তিন পথে সন্ধান করে । কোটালের পুত্রের ডিটেকটিভ-বুদ্ধি, সে কেবল জেরা করে । করতে করতে কন্যার নাড়ীনক্ষত্র ধরা পড়ে ; রূপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। শরীরতত্ত্ব, গুণের আবরণ থেকে মনস্তত্ব। কিন্তু এই তত্ত্বের এলেকায় পৃথিবীর সকল কন্যাই সমান দরের মানুষ- ঘুটে কুড়োনির সঙ্গে রাজকন্যার প্রভেদ নেই। এখানে বৈজ্ঞানিক বা দার্শনিক তাকে যে-চক্ষে দেখেন সে-চক্ষে রসবোধ নেই, আছে কেবল প্রশ্নজিজ্ঞাসা । আর-এক দিকে রাজকন্যা কাজের মানুষ । তিনি রাধেন বাড়েন, সুতো কাটেন, ফুলকাটা কাপড় বোনেন । এখানে সওদাগরের পুত্র তাকে যে চক্ষে দেখেন সে চক্ষে না আছে রস, না আছে প্রশ্ন ; আছে মুনফার হিসাব । রাজপুত্র বৈজ্ঞানিক নন- অর্থশাস্ত্রের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন নি- তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন, বোধ করি, চব্বিশ বছর বয়স এবং তেপান্তরের মাঠ । দুৰ্গম পথ পার হয়েছেন জ্ঞানের জন্যে না, ধনের জন্যে না, রাজকন্যারই জন্যে । এই রাজকন্যার স্থান ল্যাবরেটরিতে নয়, হাটবাজারে নয়, হৃদয়ের সেই নিত্য বসন্তলোকে যেখানে কাব্যের কল্পলতায় ফুল ধরে । যাকে জানা যায় না, যার সংজ্ঞানিৰ্ণয় করা যায় না, বাস্তব ব্যবহারে যার মূল্য নেই, যাকে কেবল একান্তভাবে বোধ করা যায়, তারই প্ৰকাশ সাহিত্যকলায়, রসকলোয়। এই কলাজগতে যার প্রকাশ কোনো সমজদার তাকে ঠেলা দিয়ে জিজ্ঞাসা করে না, “তুমি কেন।” সে বলে, “তুমি যে তুমিই, এই আমার যথেষ্ট ।” রাজপুত্রও রাজকন্যার কানে কানে এই কথাই বলেছিলেন । এই কথাটা বলবার জন্যে সাজাহানকে তাজমহল বানাতে হয়েছিল ।