পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৬৯

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সাহিত্যের পথে 8GS যাকে সীমায় বাধতে পারি তার সংজ্ঞানিৰ্ণয় চলে ; কিন্তু, যা সীমার বাইরে, যাকে ধরে খুঁয়ে পাওয়া যায় না, তাকে বুদ্ধি দিয়ে পাই নে, বোধের মধ্যে পাই। উপনিষদ ব্ৰহ্ম সম্বন্ধে বলেছেন, তঁাকে না পাই মনে, না পাই বচনে, তাকে যখন পাই আনন্দবোধে, তখন আর ভাবনা থাকে না - আমাদের এই বোধের ক্ষুধা আত্মার ক্ষুধা । সে এই বোধের দ্বারা আপনাকে জানে। যে-প্রেমে, যে-ধ্যানে, যে-দর্শনে কেবলমাত্র এই বোধের ক্ষুধা মেটে তাই স্থান পায় সাহিত্যে, রূপকলায় । দেয়ালে-বাধা খণ্ড আকাশ আমার আপিস-ঘরটার মধ্যে সম্পূর্ণ ধরা পড়ে গেছে। কাঠা-বিঘের দরে তার বেচাকেনা চলে, তার ভাড়াও জোটে । তার বাইরে গ্ৰহতায়ার মেলা যে অখণ্ড আকাশে তার অসীমতার আনন্দ কেবলমাত্র আমার বোধে । জীবলীলার পক্ষে ঐ আকাশটা যে নিতান্তই বাহুল্য, মাটির নীচেকার কীট তারই প্রমাণ দেয় । সংসারে মানবকীটও আছে, আকাশের কৃপণতায় তার গায়ে বাজে না । যে-মনটা গরজের সংসারের গরাদের বাইরে পাখা না মেলে। বঁাচে না সে-মনটা ওর মরেছে। এই মারা-মনের মানুষটারই ভূতের কীর্তন দেখে ভয় পেয়ে কবি চতুরানানের দোহাই পেড়ে বলেছিলেন অরসিকেষু রসস্য নিবেদনম শিরসি মা লিখ, মা লিখ, মা লিখি । কিন্তু, রূপকথার রাজপুত্রের মন তাজা । তাই নক্ষত্রের নিত্যািদীপবিভাসিত মহাকাশের মধ্যে যে অনির্বাচনীয়তা তাই সে দেখেছিল। ঐ রাজকন্যায় । রাজকন্যার সঙ্গে তার ব্যবহারটা এই বোধেরই অনুসারে । অন্যদের ব্যবহার অন্যরকম । ভালোবাসায় রাজকন্যার হৃৎস্পন্দন কোন ছন্দের মাত্রায় চলে তার পরিমাপ করবার জন্যে বৈজ্ঞানিক অভাবপক্ষে একটা টিনের চোঙ ব্যবহার করতে একটুও পীড়া বোধ করেন না। রাজকন্যা নিজের হাতে দুধের থেকে যে নবনী মন্থন করে তোলেন সওদাগরের পুত্ৰ তাকে চৌকোটিনের মধ্যে বদ্ধ করে বড়োবাজারে চালান দিয়ে দিব্য মনের তৃপ্তি পান । কিন্তু, রাজপুত্ৰ ঐ রাজকন্যার জন্যে টিনের বাজুবন্ধ গড়াবার আভাস স্বপ্নে দেখলেও নিশ্চয় দিম আটকে ঘেমে উঠবেন। ঘুম থেকে উঠেই সোনা যদি নাও জোটে, অন্তত চাপাকুড়ির সন্ধানে তাকে বেরোতেই হবে । এর থেকেই বোঝা যাবে, সাহিত্যতত্ত্বকে অলংকারশান্ত্র কেন বলা হয় । সেই ভাব, সেই ভাবনা, সেই আবির্ভাব, যাকে প্রকাশ করতে গেলেই অলংকার আপনি আসে, তর্কে যার প্রকাশ নেই, সেই হল সাহিত্যের । একান্ত বোধটিকে সাজে সজ্জাতেই শিশুর দেহে অনুপ্রকাশিত করে দেন। তৃত্যকে দেখি প্রয়োজনের বাধা সীমানায়, বাধা বেতনেই তার মূল্য শোধ হয়। বন্ধুকে দেখি অসীমে, তাই আপনি জেগে ওঠে ভাষায় অলংকার, কণ্ঠের সুরে অলংকার, হাসিতে অলংকার, ব্যবহারে অলংকার। সাহিত্যে এই বন্ধুর কথা অলংকৃত বাণীতে। সেই বাণীর সংকেত-ঝংকারে বাজতে থাকে “অলম- অর্থাৎ, “বাস, আর কােজ নেই।” এই অলংকৃত বাক্যই হচ্ছে রসাত্মক বাক্য । ইংরেজিতে যাকে real বলে, বাংলায় তাকে বলি যথার্থ, অথবা সার্থক । সাধারণ সত্য হল এক, আর সার্থক সত্য হল আর । সাধারণ সত্যে একেবারে বাহু-বিচার নেই, সার্থক সত্য আমাদের বাছাই করা । মানুষমাত্রেই সাধারণ সত্যের কোঠায়, কিন্তু যথার্থ মানুষ “লাখে না মিলল এক । করুণার আবেগে বাল্মীকির মুখে যখন ছন্দ উচ্ছসিত হয়ে উঠল তখন সেই ছন্দকে ধন্য করবার জন্যে নারদফাৰ্ষির কাছ থেকে তিনি একজন যথার্থ মানুষের সন্ধান করেছিলেন। কেননা, ছন্দ অলংকার। যথার্থ সত্য যে বস্তুতই বিরল তা নয়, কিন্তু আমার মন যার মধ্যে অর্থ পায় না। আমার পক্ষে তা অযথার্থ। কবির চিত্তে, রূপকারের চিত্তে, এই যথার্থ-বোধের সীমানা বৃহৎ বলে সত্যের সার্থকরূপ তিনি অনেক ব্যাপক করে দেখাতে পারেন। যে-জিনিসের মধ্যে আমরা সম্পূর্ণকে দেখি সেই জিনিসই সার্থক । এক টুকরো কাকর আমার কাছে কিছুই নয়, একটি পদ্ম আমার কাছে সুনিশ্চিত । অথচ কঁকার পদে পদে ঠেলে ঠেলে নিজেকে স্মরণ করিয়ে দেয়, চোখে পড়লে তাকে ভোলবার জন্যে বৈদ্য