পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (দ্বাদশ খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৪৭৪

এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

8Qや রবীন্দ্র-রচনাবলী সকল সময়েই সমান উজ্জ্বল থাকে । সেখানেও কখনো কখনো গরজের ফরমাশ যখন অত্যন্ত বড়ো হয়ে ওঠে তখন সাহিত্যে খর্বতার দিন আসে। তখন ইকনমিকসের অধ্যাপক, বায়োলজির লেকচারার, সোসিয়ালজির গোন্ড মেডালিস্ট সাহিত্যের প্রাঙ্গণে ভিড় করে ধরনা দিয়ে বসেন । সকল দেশের সাহিত্যেই দিন একটানা চলে না ; মধ্যাহ্ন পেরিয়ে গেলেই বেলা পড়ে আসতে থাকে । আলো যখন ক্ষীণ হয়ে আসে তখনি অভূতের প্রাদুর্ভাব হয় । অন্ধকারের কালটা হচ্ছে বিকৃতির কাল। তখন অলিতে-গলিতে আমরা কন্ধকাটাকে দেখতে পাই, আর তার কুৎসিত কল্পনাটাকেই একান্ত করে তুলি । বস্তুত সাহিত্যের সায়াহ্নে কল্পনা ক্লান্ত হয়ে আসে ব’লেই তাকে বিকৃতিতে পেয়ে বসে; কেননা, যা-কিছু সহজ তাতে তার আর শানায় না। যে-অক্লিষ্ট শক্তি থাকলে আনন্দ সম্ভোগ স্বভাবতই সম্ভবপর সেই শক্তির ক্ষীণতায় উত্তেজনার প্রয়োজন ঘটে । তখন মাতলামিকেই পৌরুষ বলে মনে হয় । প্রকৃতিস্থকেই মাতাল অবজ্ঞা করে ; তার সংযমকে হয় মনে করে ভান, নয় মনে করে দুর্বলতা। বড়ো সাহিত্যের একটা গুণ হচ্ছে অপূর্বতা , ওরিজিনালিটি । সাহিত্য যখন অক্লান্ত শক্তিমান থাকে তখন সে চিরন্তনকেই নূতন ক’রে প্রকাশ করতে পারে। এই তার কাজ । একেই বলে ওরিজিন্ন্যালিটি । যখনি সে আজগবিকে নিয়ে গলা ভেঙে, মুখ লাল করে, কপালের শিরাগুলোকে ফুলিয়ে তুলে ওরিজিনাল হতে চেষ্টা করে, তখনি বোঝা যায় শেষ দশায় এসেছে। জল যাদের ফুরিয়েছে তাদের পক্ষে আছে পাক । তারা বলে সাহিত্যধারায় নীেকো-চলাচলটা অত্যন্ত সেকেলে ; আধুনিক উদ্ভাবনা হচ্ছে পাকের মাতুনি- এতে মাঝিগিরির দরকার নেই- এটা তলিয়ে-যাওয়া রিয়ালিটি। ভাযাটাকে বেঁকিয়ে-চুরিয়ে, অর্থের বিপর্যয় ঘটিয়ে, ভাবগুলোকে স্থানে অস্থানে ডিগবাজি খেলিয়ে, পাঠকের মনকে পদে পদে ঠেলা মেরে, চমক লাগিয়ে দেওয়াই সাহিত্যের চরম উৎকর্ষ। চরম সন্দেহ নেই। সেই চরমের নমুনা যুরোপীয় সাহিত্যের ডাডায়িজম। এর একটিমাত্র কারণ হচ্ছে এই, আলাপের সহজ শক্তি যখন চলে যায়। সেই বিকারের দশায় প্ৰলাপের শক্তি বেড়ে ওঠে । বাইরের দিক থেকে বিচার করতে গেলে প্ৰলাপের জোর আলাপের চেয়ে অনেক বেশি, এ কথা মানতেই হয় । কিন্তু, তা নিয়ে শঙ্কা না করে লোকে যখন গর্ব করতে থাকে তখনি বুঝি সর্বনাশ হল বলে । যুরোপের সাহিত্যে চিত্রকলায় এই-যে বিহবলতা ক্ষণে ক্ষণে ও স্থানে স্থানে বীভৎস হয়ে উঠছে এটা হয়তো একদিন কেটে যাবে, যেমন করে বলিষ্ঠ লোক মারাত্মক ব্যামোকেও কাটিয়ে ওঠে । আমার ভয়, দুর্বলকে যখন ছোয়াচ লাগবে তখন তার অন্যান্য নানা দুৰ্গতির মধ্যে এই আর-একটা উপদ্রবের বোঝা হয়তো দুঃসহ হয়ে উঠবে। ভাবনার বিশেষ কারণ হচ্ছে এই যে, আমাদের শাস্ত্ৰ-মানা ধাত । এইরকম মানুষরা যখন আচার মানে তখন যেমন গুরুর মুখের দিকে চেয়ে মানে, যখন আচার ভাঙে তখনো শুরুর মুখের দিকে চেয়েই ভাঙে। রাশিয়া বা আর কোনো পশ্চিম দিগন্তে যদি গুরু নবীন বেশে দেখা দেন, লাল টুপি পরে বা যে কোনো উগ্ৰসাজেই হােক তবে আমাদের দেশের ইস্কুল-মাস্টারা অভিভূত হয়ে পড়েন । শাশুড়ির শাসনে যার চামড়া শক্ত হয়েছে সেই বউ শাশুড়ি হয়ে উঠে নিজের বধূর পরে শাসন জারি ক'রে যেমন আনন্দ পান, ঐরাও তেমনি স্বদেশের যে-সব নিরীহ মানুষকে নিজেদের স্কুলবয় বলে ভাবতে চিরদিন অভ্যন্ত তাদের উপর উপরওয়ালা রাশিয়ান হেডমাস্টারদের কড়া বিধান জারি করে পদোন্নতির গৌরব কামনা করেন। সেই হেডমাস্টারের গদগদ ভাষার অর্থ কী ও তার কারণ কী, সে কথা বিচার করবার অভ্যাস নেই, কেননা সেই হল আধুনিক কালের আগুবাক্য । আমাদের দেশের নবীন লেখকদের সঙ্গে আমার পরিচয় পাকা হবার মতো যথেষ্ট সময় পাইনি, এ কথা আমাকে মানতেই হবে । মাঝে মাঝে ক্ষণকালের দেখাশোনা হয়েছে তাতে বার বার তাদের বলিষ্ঠ কল্পনা ও ভাষা সম্বন্ধে সাহসিক অধ্যবসায় দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। যথার্থ, যে বীর সে সার্কাসের খেলোয়াড় হতে লজা বোধ করে । পীেরুষের মধ্যে শক্তির আড়ম্বর নেই, শক্তির মর্যাদা আছে ; সাহস আছে, বাহাদুরি নেই। অনেক নবীন কবির লেখায় এই সবলতায় লক্ষণ দেখা যাচ্ছে ; বোঝা যায় যে,